একটা কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা

আমার অত্যন্ত প্রিয় ফার্ষ্ট কাজিন হেনা এসেছিল ঢাকায় উন্নত চিকিৎসা নিতে। শনিবার বিকেলে সে ঢাকার এক অত্যাধুনিক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে স্বজনদের সাথে চলে গেল কুমিল্লা স্বামীর বাড়ীতে দাফনের জন্য। একজন সহজ সরল শিক্ষিকা দেড়মাস পর তার চাকুরী সমাপ্তি অন্তে অবসরে যাবার কথা ছিল। তার চিরকালের অবসর শুরু হয়ে গেল তার আগেই।
চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাষ্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার স্ত্রী হেনা। চিকিৎসায় কি ভুল হয়েছিল সে এখন এ বিচার-বিবেচনার অনেক উর্ধে। তার স্বামী এবং নিকট-স্বজনরা হেনার শরীরের অবস্থার সর্বশেষ অবনতি দেখে তার মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু কথা হল একটা কেমো থেরাপি দিয়ে যে রোগীকে বাসায় থেকে কিছুদিন পরপর থেরাপি নেবার উপদেশ দেয়া হল সেকি প্রথম থেরাপির কয়েকদিনের মাথায় সম্পূর্ন অচল হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারে?
একজন অনকোলজী বিশেষজ্ঞকে কেমো থেরাপী দেবার কথা জানালে, তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘সর্বনাশ’ করেছে। তবে তিনি এ সপ্তাহে তাকে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে জানানোর পর একদিনও হেনা টিকে থাকতে পারলনা। স্বামী ও স্বজনদের কথা, বিগত মঙ্গলবার কেমো দেবার পরের রাত থেকে আর সে স্বাভাবিক ছিলনা। কখনো উঠে বসে, কখনো অন্য রুমে যায়। তার সাথে অন্য সবাই সজাগ। পরেরদিন থেকে আর নিজে চলাফেরা করতে পারেনা। পেটে পানি জমে অনেক ফুলে যায়। এমনকি খাওয়া-দাওয়া, কথা-বার্তা বন্ধ হয়ে গেলে তাকে আবার হাসপাতালে শুক্রবার গভীর রাতে ভর্তী কর হয়। সকালে ডাক্তার এসে স্বজনদের বললেন, আপনারা চাইলে রোগী নিয়ে যেতে পারেন, তবে নিয়ে যেতে যেতে টিকবে কিনা সন্দেহ। চাইলে লাইফ সাপোর্ট দেয়া যায়। কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। লাইফ সাপোর্ট না দিয়ে তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়। ঘন্টা ছয়েক পর সে চিকিৎসকদের সব চিন্তার অবসান করে পরপারে পাড়ি জমায়।
একটা জিনিষ পরিষ্কার, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা কেমো দিয়েছিলেন রোগীর অবস্থা পুরোপুরি যাচাই না করে। যদি সে কেমো দেবার জন্য শারিরিকভাবে উপযোগী না হয় তাহলে কেন কেমো দেয়া হবে? একটা জীবন নিয়েতো অত তড়িঘড়ি করা যায়না। তাদের ভাগ্য ভাল, হেনার স্বামী এবং ভাই-বোনেরা তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে। ডেথ সার্টিফিকেট আর লাশ ফ্রিজিং ভ্যানে করে নিয়ে চলে গেছে সরাসরি কুমিল্লার বোলতা গ্রামে দাফনের জন্য। ফিটফাট এই বেসরকারি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ডাক্তার শণিবার সকালে মূমূর্ষু রোগী দেখতে এসে তাকে ডিসচার্জ করে নিয়ে যেতে বললেন কেন?
আমি ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কারণ তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। রোগী সুস্থ হলে সবাই খুশী, অবস্থা খারাপ হলে সব দোষ ডাক্তারের। তারপরও কথা থাকে।
এই হেনা আর তার স্বামী ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড় থেকে প্রানে রক্ষা পেয়েছিল, দুই ছেলে নিয়ে চট্টগ্রামে পতেঙ্গার বাসায় সিলিং-এ আশ্রয় নিয়ে। সে এক হৃদয় বিদারক বর্ণনা। ঝড় শেষ হলে সিলিং থেকে নেমে এসে দেখে বাসায় কিছু নেই। ঢলে মানুষ গবাদিপশুসহ সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পরের এক সপ্তাহ কোন কোন দিন মানুষের কাছে চেয়ে খাবার খেতে হয়েছে। অত কষ্ট করার পর সে তার চাকুরী থেকে অবসর নেবার সময় পেলনা। অবসর জীবন যাপন করতে পারলনা। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন। আমীন। ২৪ জুন ২০১৯, আমার ফেসবুক পোস্ট