করোনা লাশ দাফন ও আমার অভিজ্ঞতা! গুজব, প্রচারণা বেশী মারাত্মক

শফকত হোসাইন চাটগামী
করোনা ভাইরাস এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি ছোয়াঁছে রোগ। এটি একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। এজন্য এই রোগ হলেই তার কাছে আর যাওয়া যাবেনা!, করোনা রোগ মানেই মৃত্যু এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মাঝে। চীন থেকে শুরু হয়ে এই মরণব্যাধি ভাইরাসটি আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৬০ লাখেরও বেশী মানুষ আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। শুধু আমেরিকাতেই মৃত্যু হয়েছে এক লাখের কাছাকাছি।এই করোনা রোগ যতনা ভয়ংকর; তার চেয়ে আমাদের গুজব আর নেগেটিভ প্রচারণা আরো বেশী মারাত্মক। এই নেগেটিভ প্রচারণার ফলে সমাজ একজন করোনা রোগীর সাথে অমানবিক ও অপরাধীর মত আচরণ করছে। করোনা রোগীর কাছ দুরে সরে যাচ্ছে স্ত্রী, সন্তান, ছেলে, মেয়ে, মা বাবা থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন এমনকি পাড়া প্রতিবেশীরাও। করোনা রোগীর লাশ দাফনে পাওয়া যাচ্ছে লোকবল। এলাকাবাসী করোনা রোগীর জানাজাও পড়ছেনা। কোন কোন জায়গায় সামাজিক কবরস্থানগুলোতে করোনা রোগীর লাশ দাফনে বাধা দেয়া হচ্ছে। করোনা রোগীর চিকিৎসা করায় ডাক্তার নার্সের উপর হামলা হয়েছে। বাসা ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে বাড়ির মালিক। সন্তান তার মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে। স্বামী তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভূয়া ঠিকানায় ভর্তি করিয়ে অতপর লাশ রেখে পালিয়ে গেছে। করোনা সন্দেহে বাবার লাশ দাফনে আসছেনা সন্তানরা। কোন কোন ক্ষেত্রে সর্দি কাশি ও জ্বর হলেই করোনা রোগী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ডাক্তাররা জ্বর, সর্দি কাশি নিয়ে রোগীদের হাসপাতাল কিংবা চেম্বারে না আসতে নিষেধ করেছেন। সরকারী বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে সর্দি কাশি কিংবা জ্বরের রোগীদের হাসপাতালে না আসার নির্দেশ দিয়ে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে। ভাবখানা এমন যেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি মহা অপরাধ করেছেন। পুরো সমাজ তার সেই অপরাধের যেন ঘৃণা করতে প্রতিযোগী শুরু করেছেন। করোনা রোগীকে জেনা ব্যাভিচার এবং চোর ডাকাত সন্ত্রাসীর চেয়েও বেশী ঘৃণা করছি আমরা। কিছু বুদ্ধিজীবি ও নাস্তিকপন্থী টিভি মিডিয়া টকশোতে করোনায় আক্রান্তদের লাশ দাফনের পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলার আবদারও করে। যদিও ডাক্তাররা জোর দিয়েই বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা যেকোন রোগে-ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ৩ ঘন্টার বেশী জীবাণু স্থায়ী হয়না। মারা যাওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের জীবাণুও মরে যায়। তবুও এক শ্রেণীর মানুষ নামক কীট মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলতে আজগুবী ও গাজাখোরী প্রস্তাব করে। এমন ভয়াবহ অবস্থায় কিছু মানবদরদী আলেম ওলামা ও সংগঠন করোনা লাশ দাফনে এগিয়ে এসেছেন।
করোনা ভাইরাসকে ইতিমধ্যেই দুর্যোগ ও মহামারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামে মহামারী ও দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণকারীদের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় এই করোনা দুর্যোগে প্রাণ হারানো শহীদদের দাফন কাফনে শরীক হতে পারা কত বড় ফজিলত ও পুণ্যের কাজ তা বলে শেষ করা যাবে না। এমনিতেই একজন মুসলমানের দাফন কাফন এবং জানাজা ফরজে কেফায়া। পুরো গ্রামবাসীর কেউ যদি মৃত্যু ব্যক্তির কাফন দাফন ও জানাজা না দেন তাহলে এলাকাবাসীর সকলে মারাত্মকভাবে গুনাহগার হবেন। তাই যত বড় ভাইরাস কিংবা যত বড় দুর্যোগই হোক; একজন মুসলমানের অবশ্যই কাফন দাফন ও জানাজা দিতে হবে।
মানবিক কারণে সারা দেশে আজ আলেম সমাজ করোনা রোগীর দাফন কাফনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন। তারই অংশ হিসেবে গতকাল ২৭ মে বুধবার বাঁশখালীর শেখেরখীলে শওকত আলম চৌধুরী নামে এক করোনা রোগীর লাশ দাফন করি আমরা। এই লাশ দাফন করতে গিয়ে বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় আমাদেরও। যেন করোনা লাশ দাফন করে আমরাও সমান অপরাধী হয়ে গেলাম। লাশ দাফনকারীদের স্যালুট না জানিয়ে অনেকেই দেখছি বাঁকা চোখে দেখার পাশাপাশি বেশ অবমাননাকর আচরণ করছে আমাদের সাথে। যা সত্যিই বেদনাদায়ক। টিমের একজন সদস্য জানান, নেগেটিভ প্রচারণার ফলে লাশ দাফন করতে যাচ্ছেন শুনে তার স্ত্রী ওই সদস্যকে লাশ দাফনে আসতে বারণ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোন লুকিয়ে রাখেন। পরে স্ত্রীর বাধা উপেক্ষা করেই তিনি লাশ দাফনে আসেন। অপরদিকে আমি লাশ দাফনে অংশ নিয়েছি শুনে আমার এক সহকর্মী সংবাদকর্মী ভয়ে আমার আশপাশে আসছেন না। এমনকি তিনি লোকজনকেও আমার আশপাশে না ঘেঁষতে বার বার সতর্ক করছেন। বলছেন লাশ দাফন কাজে অংশ নেয়ার কারণে ৭২ ঘন্টা নাকি কেউ আমার আশপাশে আসতে পারবেনা। অথচ পিপি, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্কসহ যাবতীয় সুরক্ষা পড়েই আমরা লাশ দাফন করেছি। লাশ এবং আমাদের বার বার স্প্রে করা হয়েছে। দাফন কাফনের পর টিমের সবাই স্পটেই গোসল করেছি। সব দিক সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে টিমের পক্ষ থেকেই। যদিও মৃত্য ব্যক্তির শরীরে বেশীক্ষণ করোনা ভাইরাস থাকেনা বলে গবেষকরা সাফ জানিয়েছে। তার পরও এত আতংক এবং নেগেটিভ প্রচারণার কোন মানে হয়না।
সবচেয়ে লাশের স্বজন এবং প্রতিবেশীদের কিছু আচরণ আমাদের বেশী কষ্ট দিয়েছে। যার লাশ দাফন করলাম তিনি জমিদার ফ্যামিলির সন্তান। গ্রামে রাজকীয় বসতভিটা। বিশাল পুকুরসহ বড় এরিয়া নিয়ে তার বাড়ী। শেষ যাত্রায় তিনি তার বাড়িতে ঢুকতে পারেন নি!
আমরা পৌছতে দেরি হলে তার লাশ সড়কেই এম্বুলেসসহ রেখে দেয়া হয়। আমরা শেখেরখীল পৌছে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাশ গাড়ি থেকে নামিয়ে লাশের গোসল এবং কাফন পড়াই। গোসল ও কাফন শেষে লাশ দাফন ও জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে আমরা স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের লাশ দেখতে আহবান করি। কিন্তু তারা লাশের চেহেরা দেখতে ঘর থেকে বের হননি। বেচারা লাশকেও একটি বারের জন্য আর ঢুকাননি। শেষ পযর্ন্ত আমরা কাঁদে করে লাশ দাফনে নিয়ে যাই। সে সময় খাটিয়া বহনে আমাদের অনুরোধে তার ভাইসহ কয়েকজন এগিয়ে এলেও জানাজায় ঘনবসতি পাড়ায় আমরা টিমের ১০ জনের বাইরে মাত্র ১০/১৫ জন অংশ নেন। আমরা শেখেরখীল পৌছতে গিয়ে যাত্রাপথে গাড়িতে থাকা অবস্থায় দাফন ও জানাজা স্পটের যাতায়াত লোকেশন জানতে এক আত্মীয় যিনি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন তাকে ফোন দিলে তিনি আমাদের যাতায়াত পথ দেখিয়ে দিলেও বাড়িতে অবস্থান করে কাছেই তিনি জানাজায় আসেননি। মুলত: জানাজা ফরজে কেফায়া হলেও জানাজার চেয়ে একজন আত্মীয় কাছের মানুষ প্রিয় মানুষকে শেষ বারের মত দেখা এবং শেষ বিদায় জানানোটা আমার কাছে বেশ গুরুত্ব বহন করে। যাক, আমরা শান্তিপুর্ণভাবে লাশের কাফন, দাফন এবং জানাজা শেষ করে চলে আসার পালা। আসার সময় টিমের এক সদস্য তার হ্যান্ড গ্লাভসটি খুলে সড়কের পাশের ডোবায় ফেলে দেয়। এতেই ঘটে বিপত্তি। প্রতিবেশী কয়েকজন দৌড়ে এসে সেই ফেলে দেয়া গ্লাভসটি ওখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে দুরে কোথাও দুরে যেতে আমাদের নিকট দাবী করে। তারা বলে এতে নাকি পুরো এলাকা করোনা হয়ে যাবে!!!
হায়! হায়!!! কোন চিন্তা চেতনা নিয়ে তাদের বসবাস! বার স্প্রে করা একবার ব্যবহার করা একটি হ্যান্ড গ্লাভসকেও সহ্য করলনা এলাকাবাসী। অথচ তারাই আবার কোন ধরণের সামাজিক দুরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গ্রামের চা দোকান থেকে শুরু করে সারা দিন বাইরে আড্ডা এবং ঘুরা ফিরায় মত্ত থাকেন। আমরা শত বুঝিয়েও কাজ হয়নি। শেষ পযর্ন্ত সেই গ্লাভসটি আমাদের সরিয়ে নিতেই হল।
করোনা নিয়ে, করোনা রোগী ও করোনা লাশ নিয়ে আমাদের এই নেগেটিভ চিন্তা বড়ই দুঃখ জনক। এভাবে চলতে থাকলে আপনি ভাবুন তো! হঠাৎ একদিন যদি আপনি/আমি করোনায় আক্রান্ত হই তাহলে আপনাকে আমাকে নিয়েই পরিবার, সমাজ এমন অমানবিক সব আচরণ করবে। এমন ঘৃণিত আচরণ জুটবে আমাদের কপালেও। অতএব সাবধান, করোনা রোগী, করোনা লাশের প্রতি মানবিক হই। ঘৃণার বদলে তাদের ভালবাসা দেই। আল্লাহ এই মহামারী করোনার কবল থেকে আমাদের হেফাজত করেন আমিন।
নোট : সুত্র ছাড়া কপি করা নিষেধ। কাজী আজিজুল হকের ইমেইল থেকে প্রাপ্ত।