ছোঁয়াছে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার কী করণীয়?

– ডাঃ জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী।
‘মহামারী আল্লাহর আযাব’- হযরত আয়েশা (রা.)।
‘মহামারী পীড়িত গ্রাম বা শহরে প্রবেশ নিষেধ। পক্ষান্তরে কেউ যদি পূর্বে আক্রান্ত জায়গায় থাকে, তাহলে সেখান থেকে পলায়ন করা নিষিদ্ধ। মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে পলায়ন জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন তুল্য অপরাধ’- বুখারী ৩৪৭৩, ৫৭২৮।ছোঁয়াছে রোগের সূচনা: আফ্রিকার মুর মুসলমানরা তারিক বিন জাহিদের সেনাপতিত্বে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে জিব্রালটার বিজয় করে ক্রমে ৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুরো স্পেন ও পর্তুগালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং কর্ডোবায় রাজধানী স্থাপন করে। বর্তমানের বহুল প্রশংসিত কর্ডোবা ক্যাথেড্রাল সাতশত বছর (৮০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) যাবৎ পরিচিত ছিল আকর্ষণীয় কর্ডোবা মসজিদ রূপে, যা স্থাপন করেছিলেন মুসলিম মুর শাসকরা। পনের শতাব্দীতে মুসলিম শাসনের পতন হলে স্পেনিয়ার্ডরা কর্ডোবা মসজিদের নতুন নামকরণ করে কর্ডোবা ক্যাথেড্রাল নামে। কর্ডোবা ক্যাথেড্রালের স্পেনীয় নাম হচ্ছে ‘La Megquita’ মানে ‘দি মস্ক- মসজিদ’।
মুসলমানদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধাবিভক্তির কারণে ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। একই বছর পরিব্রাজক ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন মহাদেশ আমেরিকা খুঁজে পান এবং সেখান দিয়ে আসেন ইউরোপের রোগ হাম, বসন্ত ও যৌন রোগ গনোরিয়া। সংগে নিয়ে আসেন বিস্তর স্বর্ণখন্ড ও যৌন ছোঁয়াচে রোগ সিফিলিস। সিফিলিস রোগের জীবাণুর নাম ট্রেপোনোমা প্যালিডিয়াম। কলম্বাসের নাবিকদের অবাধ যৌন বিহারে মাধ্যমে সিফিলিস পুরো আন্দুলুসিয়া, পর্তুগাল ও ইটালিতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯৬ সালে ছড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডে। ফ্রান্সের সম্রাট অষ্টম চার্লস বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিরাট ভাড়াটে সেনাদল নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৪৯৫-এ ইটালিতে প্রবেশ করেন, পথিমধ্যে ব্যাপক যৌন আমোদে অংশ নিয়ে নেপলস পৌঁছেন ১২ মে ১৪৯৫-এ। প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন জুলাই মাসে, সংগে নিয়ে আসেন ‘রেঁনেশা জীবাণু’, যা ফ্রান্সে পরিচিতি লাভ করে ‘নেপোলিয়ান ব্যামো’ বা ফরাসী ব্যামো নামে, যার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে জার্মানি ও উত্তর পূর্ব ইউরোপে।
ভাস্কো ডি গামা ৮ জুলাই ১৪৯৭ তারিখে বিরাট নৌবহর নিয়ে লিসবন ছাড়েন এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে কালিকটে তরী ভিড়ান ১৭ মে ১৪৯৮-এ। তার নাবিকরা ভারতীয় নারীর মধ্যে প্রসার ঘটায় ফিরিঙ্গি রোগ নামে খ্যাত সিফিলিসের। এ রোগ ১৫১০-২০ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, জাপান ও চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে সিফিলিসের পরিচিতি ছিল ‘চৈনিক ঘা’ নামে।
১৯৪৬ সালে এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন বাজারজাত না হওয়া পর্যন্ত যৌনাচারে সংক্রমিত সিফিলিস রোগ সারা পৃথিবীকে ছয়শত বছর যাবৎ পর্যুদস্ত করে রেখেছিল। অনেকটা আজকের ছোঁয়াচে রোগ করোনা সংক্রমণের ধারায়।
১৯২৮ সালে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরোটরিতে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরি, আর্নেস্ট বরিস চেন ও নরমান হিটলির সম্মিলিত গবেষণায় এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়। যে কয়েকটি পাত্রে প্রথম পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়েছিল, তার একটি পাত্র বিজ্ঞানী নরমান হিটলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে উপহার দেন ১৯৮০ সালে, যা বর্তমানে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রক্ষিত আছে।
পেনিসিলিন প্রথম ব্যবহৃত হয় লন্ডনের পুলিশ আলবার্ট আলেকজান্ডারের প্রদাহ নিবৃত্তির জন্য ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৪১ তারিখে। পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এাবট, লিডারলি, ফাইজার, মার্ক ও স্কুইবের ভূমিকা স্মরণযোগ্য।
ভয়ানক ছোঁয়াছে করোনা ভাইরাসের ইতিবৃত্ত: ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাক্কালে ৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলেরা জীবাণুর মাধ্যমে জীবাণুযুদ্ধের বিস্তারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করেছিল ঢাকার মহাখালীস্থ সিয়োটা কলেরা ল্যাবরোটরিতে, যা বর্তমানে আইসিডিডিআরবি (ICDDRB) নামে বিশ্বখ্যাত।
এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে সারস করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) সংক্রান্ত গবেষণা চলছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উহানের গবেষণাগারে। জনশ্রুতি আছে, জীবাণুযুদ্ধে ভাইরাস ব্যবহারের উপযোগিতা পরীক্ষা ছিল মূল লক্ষ্য। কথিত আছে, চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হুবাইর রাজধানী উহানে প্রাণীবাজার থেকে করোনা ভাইরাস ২০১৯ সালের নভেম্বরে মানুষে সংক্রমিত হয়। সারস ভাইরাস ৩৮৪ বার পরিবর্তিত হয়ে করোনা নভেল রোগ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগকে কোভিড-১৯ নামকরণ করে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে এবং কোভিড-১৯ কে মহামারী হিসাবে আখ্যায়িত করে ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে। কোভিড-১৯ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াছে, মানুষ থেকে মানুষে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন, বিনোদন বা পরিজনের সাথে সময়যাপনের নিমিত্তে আগমন।
কোভিড-১৯ এর উপসর্গসমূহ হচ্ছে জ্বর, কাশি, হাঁচি, মাংসপেশীর বেদনা, গলাদাহ, যা ২-১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত চিকিৎসা না হলে নরম ফুসফুস পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।
১৯ মার্চ ২০২০ সাল অবধি ৮,০০০ এর অধিক কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৭০টি দেশে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি রোগী আছে চীন, কোরিয়া, ইরান, ইটালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশে প্রমাণিত কোভিড-১৯ রোগী মাত্র ১৭ জন এবং একজন মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ রোগ আক্রান্তদের সংখ্যা যে লাফিয়ে বেড়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
১). বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর প্রবেশ দ্বার
ক). ভারত সীমান্ত: ভারতের সাথে বাংলাদেশের ২,৫০০ কিলোমিটারের অধিক সীমান্ত রয়েছে। কয়েকশত পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। তদুপরি রয়েছে প্রতিদিন কয়েকশত ভারতীয় ট্রাকের বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় নিয়মিত কর্মে লিপ্ত। অনুমোদনবিহীন ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থানের সঠিক তথ্য নেই। প্রতিদিন কয়েক হাজার ভারতীয় স্থলপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং প্রত্যাবর্তন করে। এদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সমধিক। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিদিন কয়েক হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসা, বিনোদন ও হুন্ডি ব্যবসার নিমিত্তে ভারতে আসা যাওয়া করে। এ যাতায়াত বন্ধের জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল মাত্র সকল স্কুল, কলেজ বন্ধ ঘোষণা যথেষ্ট না।
খ) কারাগার থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের অগ্ন্যুৎপাত হবার আশঙ্কা সমধিক: বাংলাদেশের সকল কারাগারের মিলিত বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানি, পুলিশের ঘুষবাণিজ্য ও আইন শৃংখলার অবনতির কারণে কারাবন্দি আছে প্রায় ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) ব্যক্তি। কারাগারের জনাকীর্ণতা কোভিড-১৯ এর জন্য উন্মুক্ত দ্বার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে সরকারের উচিত হবে ফাঁসির আসামী, যাবজ্জীবন ও দশ বছরের অধিক দন্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য সকল দন্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্তের ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দিয়ে দেয়া এবং বুঝিয়ে বলা, পরিবারের বাইরে যেন তারা বিচরণ না করে।
গ) আদালত প্রাঙ্গণ ও কোর্টসমূহ: সকল সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত কয়েক লাখ চিন্তিত ব্যক্তি ও উকিল মুহুরী ও অন্যান্য কর্মচারী আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত ভয়ানক ভীড় করে থাকেন। একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে থাকেন। আদালতে এত মামলার মূল কারণ রাজনৈতিক হয়রানি ও পুলিশের অনৈতিক ঘুষবাণিজ্য। বিশ্ব কোভিড-১৯ এর ছোঁয়াচে সংক্রমণ বিবেচনায় নিয়ে উচিত হবে ৭০ ভাগ অভিযুক্তদের ২০৫ ধারায় কোর্টে উপস্থিতি থেকে রেহাই দেয়া, যতদিন না মামলার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। দ্বিতীয়ত: অন্যদের ক্ষেত্রে সকল মামলার শুনানি ও উপস্থিতির জন্য তিনমাস অন্তর তারিখ দেয়া।
ঘ) রোহিংগা আশ্রয় শিবিরে (ক্যাম্পে) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাড়ানো প্রয়োজন: রোহিংগা ক্যাম্পসমূহ অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং সেখানে সাধারণ জীবনযাপনের পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা নেই। রোহিংগারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না আসে সেদিকে যেমন লক্ষ রাখতে হবে, একইভাবে স্থানীয় জনসাধারণের ক্যাম্পে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২). মসজিদ, মন্দির, গির্জা প্যাগোডা খোলা থাকবে: তবে উপাসনালয়ের প্রবেশ পথে ভক্তদের ৬-১০ ইঞ্চি দূর থেকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা উপযুক্ত কাজ হবে। মসজিদে খুতবায় কোভিড-১৯ সম্পর্কে ভক্তদের তথ্য দিতে হবে, গুজব না ছড়িয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে পাড়াপরশীদের বিদেশ প্রত্যাগত আত্মীয়স্বজনকে ১৪ দিন আলাদা রাখার পরামর্শ দিতে হবে। একইভাবে বাড়ির সকলকে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া ও কুনুই পর্যন্ত ধুয়ে অজু করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। হাত মেলানো ও আলিঙ্গন পরিহার করতে হবে, না ছুঁয়ে সালাম দেবার অভ্যাস করতে হবে। হ্যান্ডসেক নয়, সালাম দিন বা নমস্কার করুন। মন্দির, গীর্জা প্রভৃতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ঐ রূপ সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হবে।
৩). জনসমাবেশ স্থলে তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে: বাস-ট্রেন স্টেশন, বন্দর, বাজার ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে, হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। বাড়িতে ফিরে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া এবং আলিঙ্গন, হ্যান্ডসেকের পরিবর্তে হাত তুলে সালাম বা নমস্কার দেবার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৪). বিদেশ থেকে প্রত্যাগত নাগরিকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন: প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের সমৃদ্ধির যোগানদার। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ২৫ লাখ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ওষুধবিদ, আইটি পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। এরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশে রাখেন। দেশে পাঠান না। বাকী প্রায় ৭৫ লাখ সাধারণ শ্রমজীবী প্রবাসী বাংলাদেশিরা দশ মাসে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম পরিমাণ অর্থ। পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে বাংলাদেশিরা কঠিন শ্রমদিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রতি ৩-৪ বছর পরপর তারা স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও আত্মীয়দের দেখার জন্য দেশে ফেরেন ১০ থেকে ৪০ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ করে। তাদের সঙ্গে অবশ্যই সদয় ব্যবহার করতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের নিমিত্তে বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা বিজ্ঞান সম্মত। তারা যদিও ‘নবাবজাদার অর্ভ্যথনা’’ প্রত্যাশা করে না, তবে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হবে যে তাদেরকে ১৪ দিন আহার বিশ্রামের জন্য ৫ তারকা তুল্য অর্ভ্যথনা ও সুযোগ সুবিধা দেয়া। দীর্ঘদিন পরে যারা আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যাচ্ছেন তাদের আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক কারণ ভালভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে বাড়ির বাইরে ১৪ দিন ঘোড়াফেরা না করেন। জরিমানা করা অমানবিক ও ভুল কাজ।
৫). সরকারি ব্যবস্থাপনা অনেকগুণ বাড়তে হবে: পৃথিবীর সকল দেশ কঠিন সমস্যায় পতিত হয়েছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে হাসপাতাল, ক্লিনিক নামক অজস্র ভবন আছে, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল নাই সরকারি ভুল নীতিমালার কারণে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর- ‘Institute of Epidemiology, Disease Control and ResearchÕ এ রিভার্স পলিমারজ চেইন রিএকসন (PCR) পরিচালনায় দক্ষ ৫০ জন ভিরোলজিস্ট, এনটোমোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই।
সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবরোটরিতে উন্নত মানের পিসিআর (চঈজ) নেই। তদুপরি বাংলাদেশে মেডিকেল যন্ত্রপাতির উপর অদ্ভুত ধরনের অতিরিক্ত শুল্ক ও বিবিধ কর প্রয়োগের নিয়ম প্রযোজ্য আছে। মেডিকেল শয্যার উপর সর্বমোট কর হচ্ছে ৫৮%, গ্যাস এনালাইজার, ভেন্টিলেটর, থার্মোমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপর ধার্য সর্বমোট শুল্ক হচ্ছে ৩১%। এই সঙ্গে কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য অন্যান্য উপরি ব্যয় তো আছেই।
সকল মেডিকেল যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় রি এজেন্ট ও সামগ্রীর উপর ০% (জিরো ট্যাক্স) করা সরকারের আশু দায়িত্ব। সকল প্রবেশ পথে পর্যাপ্ত স্ক্যানার ছাড়াও কমপক্ষে ২০-৩০টা হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিন শিফটে কাজ চালু রাখার মতো স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভান্ডারে মাত্র ১,৭৩২ কোভিড-১৯ রোগ জীবাণু পরীক্ষার কিট আছে। আইইডিসিআর কোভিড-১৯ শনাক্ত করার জন্য মাত্র ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। যে কোন একটি উপসর্গ থাকলেই চিন্তিত রোগীর নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। প্রস্তুতি থাকতে হবে, মাসে কয়েক লাখ সম্ভাব্য রোগীর নমুনা পরীক্ষা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী দি ল্যানসেট-এ প্রকাশিত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতির তথ্য।
সরকারকে অনতিবিলম্বে আগামী এক মাসের মধ্যে একলাখ চিকিৎসক ও দুই লাখ নার্স টেকনিশিয়ান প্যারামেডিক ও ফিজিওথেরাপিস্টদের কয়েকঘণ্টা করে করোনা রোগের ধরন, উপসর্গ বিস্তৃতি, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আলিঙ্গন বা হেন্ডসেক না করে সালাম বা নমস্কার দেবার অভ্যাস করা ও সম্ভাব্য রোগীকে দেখে চিকিৎসক ও নার্সদের ভয়ে পালিয়ে না যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শেখাতে হবে যে রোগীকে পরীক্ষা না করে পালানো, রসুলুল্লাহর মতে জিহাদের মাঠ থেকে পলায়নতুল্য। চিকিৎসক ও নার্সদের ভালো করে হাত না ধোয়া সম্পর্কে বৃটিশ মেডিকেল জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর পূর্বে।
৬). দেশীয় বিজ্ঞানীদের সহায়তা করুন, সম্মান দিন: সরকারি সহযোগিতা পেলে গণস্বাস্থ্য এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট (G-Rapid Dot Blot) বাজারজাত করবে। ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুরে ২০০৩ সালে সারস ভাইরাস নির্ণায়ক- রেপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেলসের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন কুমার শীল ও তার তিনজন সহকারী ড. নিহাদ আদনান, ড. ফিরোজ আহমদ ও ড. বায়জিদ জমির উদ্দীন গণস্বাস্থ্য ল্যাবরোটরিতে এন্টিবডিএসেজ (ইমমিউনোগ্লােবিন-এ, ইমমিউিগ্লােবিং- জি ও ইমিউনোগ্লােবিল-এম ইমমিউনোত্রসেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাস নির্ণায়ক পদ্ধতি রেপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন করেছেন। সরকার দ্রুত বিভিন্ন করোনা ভাইরাস এন্টিবডি, নিউ ক্লোপ্রোটিন, স্পাইন গ্লাইকোপ্রোটিন, করোনা ভাইরাস এনভেলাপ প্রোটিন প্রভৃতি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহের অনুমতি দিলে বাজারজাত করণের জন্য পর্যাপ্ত রেপিড ডট ব্লট প্রস্তুত হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। প্রতিটির উৎপাদন খরচ হবে দুইশত টাকা, সরকার শুল্ক, বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মত্তকুফ করে দিলে জনগণ মাত্র তিনশত টাকায় পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। পিসিআর পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ভিজিজ কন্ট্রোল রেপিড ডট ব্লট উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং গণস্বাস্থ্যের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
শেষকথা, সঠিক তথ্য দিন, গুজব ছড়াবেন না, বাংলাদেশের জনগণের উপর আস্থা রাখুন। ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীসহ সকলে সাবান দিয়ে বারে বারে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, হ্যান্ডশেক নয়, সালাম বা নমস্কার দিন। ‘আল্লাহর আযাব’ থেকে নিশ্চয়ই সবাই মুক্তি পাবেন।
তথ্যসূত্র:
১. হিস্টরি অব সিফিলিস অধ্যাপক ক্লড কুইটেল, প্যারিস ১৯৮৬।
২. সারস রোগ নির্ণয় পেটেন্ট, ড. বিজন কুমার শীল, ২০০৩।
৩. করোনা রোগ ২০১৯ উইকিপিডিয়া/ সিডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র / বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।