ফয়জুল করীম, বাবুনগরী, মামুনুল হক-এর মামলা প্রত্যাহারের দাবী

আপনারা বর্তমান পরিস্থিতি জানেন। একটি সুবিধাভোগী মহল সাধারণ মুসলিম জনতার উত্থাপিত একটি মতামতকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে লম্ফ-ঝম্ফ, হুমকি-ধমকি দিয়ে বিশৃংখলা তৈরীর চেষ্টা করছে। তাদের পেছনে বাংলাদেশের অর্জন, উন্নয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বিনাশে কর্মরত কিছু দেশী-বিদেশী চক্রেরও ইন্ধন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঢাকা কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে স্থাপিত হতে যাওয়া ভাস্কর্য নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরী হয়েছে। স্থানীয় ইমাম মুসল্লি ও তৌহিদী জনতা সেখানে ভাস্কর্যের বদলে বিকল্প কোন উত্তম পন্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখার দাবী জানিয়ে ছিলো।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
আপনারা জানেন, বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান আইন কানুন মেনেই তৌহিদী জনতা সমাবেশ করেছে এবং সেখানে শালীন ভাষাতেই যৌক্তিক ভাবে ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করা হয়েছে। একই সাথে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোর বিকল্প পন্থাও প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি একেবারেই স্বাভাবিক একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, একটি সুবিধাভোগী মহল বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশে চরম উস্কানী ও উত্তেজনা তৈরী করছে।
সরকার যেখানে প্রতিবাদ সমাবেশের অনুমতি দিয়ে যৌক্তিক আলোচনা ও মতামতের পরিবেশ সংযমের সাথে বজায় রেখেছে সেখানে জনবিচ্ছিন্ন সুবিধাভোগী শ্রেণিটি উলামায়ে কেরামকে সন্ত্রাসী ভাষায় গালিগালাজ করছে, ঢালাওভাবে অপবাদ দিচ্ছে। মাহফিলের মতো চিরায়ত ধর্মীয় সংস্কৃতিকে উগ্রপন্থায় প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছে। রাজপথে সন্ত্রাসী কায়দায় উগ্র বক্তব্য ও শ্লোগান দিচ্ছে। প্রকাশ্যে আলেমসমাজকে মারধর, অপমান এমনকি তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
এহেন পরিস্থিতিতে আমরা পরিষ্কার করে জানাচ্ছি যে, উলামায়ে কেরামের দাবীর মধ্যে মরহুম বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোন বিদ্বেষ ছিলো না, অসম্মানও ছিলো না। বরং বিষয়টি ছিলো দেশের প্রায় ৯০%জনগণের বোধ বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ভাস্কর্য স্থাপন না করে অন্য কোন পন্থায় তাকে স্মরণ করার দাবী। যা অনেকটা মুসলিম রাষ্ট্রনায়ককে ইসলামের আলোকে দাফন কাফন না করে বিধর্মীয় পন্থায় তার শেষকৃত্য করার মতই নিন্দনীয় কাজ। আলেমসমাজ ও সাধারণ মুসলিম ধর্মপপ্রাণ জনগণ এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে নিজেদের প্রাণের আকুতি তুলে ধরতেই পারে। মানা না মানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
এই যৌক্তিক দাবীকে কেন্দ্র করেই তারা তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত ভাস্কর্য প্রীতি ও বিজাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বিষয়টিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে অপদস্থ করার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। এসব কোন দেশপ্রেমিক মানুষের কাজ হতে পারে না।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫০বছর হতে চলছে। ঐক্যবদ্ধ এই জাতি মাত্র ৯মাসে দেশটাকে স্বাধীন করেছে। এখানকার মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মও প্রায় এক। এমন ঐক্যবদ্ধতা যে কোন জাতির জন্যই গর্ভের। কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ করছি, একটি মহল জনতার এই ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করতে চায়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। দেশ পরিচালনায় প্রত্যেক নাগরিকের মতামত প্রকাশের ইখতেয়ার রয়েছে। সরকারের কোন কোন সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা ও বিরোধিতা সভ্য সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের কোন কাজের সংশোধনমূলক পরামর্শ প্রদান গঠণমূলক সামালোচনা বা বিরোধিতা করলেই চিহ্নিত মহলটি পাকিস্তানপন্থী, রাজাকার, আলবদর, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ইত্যাদি বলে ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি হামলে পড়ে।
এতে করে জনগনের মধ্যে ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরী হয়। আমরা মনে করি বিষয়টি জাতীর উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়। প্রসঙ্গতঃ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পরিবার ৭১ সালে একনিষ্ঠভাবে মুক্তি সংগ্রামের সহযোগী ছিলেন। তার দরবার ছিলো এলাকার সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের আশ্রয়স্থল। বিষয়টি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সর্বজন বিদিত। যারা এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুক্তি যুদ্ধের চেতনাকে তামাশায় পরিণত করছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
উলামায়ে কেরাম কোরআন হাদিসের আলোকে তাদের মতামত জানান মাত্র। তারা কখনোই কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে বলেন না। একই ধারাবাহিকতায় ধোলাইপাড়ের ভাস্কর্য নিয়ে তারা তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। এর সাথে দেশের অন্য মুর্তি ভাঙ্গার কোন সম্পর্ক নেই। বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনার সাথে উলামায়ে কেরামের মতামতকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পৃক্ত করা উলামা ও ইসলাম বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে যারা তাঁর বেশি বিরোধিতা করেছে, বঙ্গবন্ধুর চামড়া খুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরী করেছে, মৃত্যুর পরে আনন্দ-উল্লাস করেছে, তারাই আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মান রক্ষার নামে অপসংস্কৃতি প্রসারে সবচেয়ে এগিয়ে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, এরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও মূল আওয়ামীগের চেয়েও বেশী মুজিবভক্ত হয়ে গেছে। এখানে মনে হওয়া যৌক্তিক যে, বঙ্গবন্ধুর সম্মান তাদের উদ্দেশ্য না; বরং তাওহিদ বিরোধী মুর্তিবাদী আদর্শ বিস্তারই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যা এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনা বিরোধী। তাছাড়া, সরকারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করার এবং দেশের সামগ্রিক সম্প্রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করাও তাদের দূরবর্তী লক্ষ্য।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
ভাস্কর্য ইস্যুতে চরম উস্কানীর মুখেও দেশের শান্তি ও স্থিতিশিলতা বজায় রাখার স্বার্থে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সীমাহীন ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়ে এসেছে। কিন্তু এরই মাঝে গতকাল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি ভূইফোড় সংগঠন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের নামে একটি জঘন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। সঙ্গে আরো দুইজন বিশিষ্ট আলেম আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মাওলানা মামুনুল হকের নামেও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আমরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু মনে করিনি। যে কারনে ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণ করেছি মাত্র। আমরা আমাদের দলীয় ব্যানারে বা কোন সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে কোন কর্মসূচিও দেইনি।
উগ্রবাদী শক্তি ও তাদের উশৃঙ্খল সহযোগীরা আমাদের নিরবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। আমি সরকারকে এসব অন্যায় সীমালঙ্ঘনকারীদের নিবৃত করার অনু্েরাধ জানাই ও ক্ষমতাসীন সরকার এবং তাদের সুবিধাভোগী উগ্র সমর্থকদের সতর্ক করে বলতে চাই, এদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানরা আজ ঐক্যবদ্ধ। শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রাণ মানুষের ধৈর্য্যেরও একটা সীমা আছে। আমরা অনেক অপমান সহ্য করেছি। সরকার যদি তাদের সুবিধাভোগী উগ্র সমর্থক এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী শক্তিগুলোর বাড়াবাড়ি ও উস্কানীমূলক কর্মকান্ড বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সাধারণ দেশপ্রেমিক জনতা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবে।
সাংবাদিক বন্ধুগণ!
ভাস্কর্য নিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতিকে আমরা দেশ বিরোধী অপশক্তির চক্রান্ত আকারে দেখছি। আমরা মনে করছি, ওরা বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করে ভিনদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে চায়।
এ বিষয়টিতে সরকারের অবস্থান নিয়েও আমরা হতাশ। সাধারণ মানুষের নিয়মতান্ত্রিক একটি দাবীকে কেন্দ্র করে যখন কুচক্রিমহল দেশে উলামাদের বিরুদ্ধে উগ্রতা ছড়াচ্ছে, তখন তারা তা দমন না করে আরো উৎসাহ দিচ্ছে।
আমরা মনে করি, তাদের এই ভূমিকা বরং বঙ্গবন্ধুকে ছোট করছে। তাঁর সম্মানকে মানুষের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। অথচ এর কোন দরকার ছিলো না। জনগণ মনে করছে, সরকার তাদের ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং অনিয়ম আড়াল করতেই এই অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
পরিশেষে
আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মাওলানা মামুনুল হক এর মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানাচ্ছি। পাশাপাশি যারা দেশের ওলামা সমাজকে এবং সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে, কটুক্তি করে, ব্যাঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করে অপমান অপদস্ত করে, প্রাণ নাশের হুমকি দেয়, সংঘাত, মারামারি ও মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানায় তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করছি।
আমরা আশা করছি সরকার আমাদের যৌক্তিক দাবী মেনে নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আর সরকার যদি ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজেদের নিরাপত্তা, মর্যাদা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনেই দেশের জনগণ কে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচী দিতে বাধ্য হবে।
মুফতি সৈয়দ মোহাম্মাদ রেজাউল করীম, পীর সাহেব চরমেনাই, আমীর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ