বড় বাজেট কি আসলেই বড়?

বাংলাদেশে প্রথম বাজেট হয় ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ৭শ’ ৮৬ কোটি টাকার৷ আর ২০১৭-১৮ সালের বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার৷ ৪৬ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৪৩২ গুন৷ জনসংখ্যা হয়েছে আড়াই গুন৷ বাজেটের কি শুধু আকারই বেড়েছে? ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন সেই সময়ের বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ৷ আর সেই বাজেট ছিল ৭’শ ৮৬ কোটি টাকার৷ চলতি বাজেট ওই বাজেটের চেয়ে ৪৩২ গুন বড়৷ আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, ২০১৮-১৯ সালের বাজেট হবে আরো বড়– ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার৷খবর – ডয়চে ভেলে বাংলা ।
বাংলাদেশের বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি গুণগত পরিবর্তনও এসেছে? সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসলেই কি বাজেটের আকার বেড়েছে কিনা, সেই প্রশ্নও তুলছেন অর্থনীতিবিদরা৷ তাঁরা বলছেন, বাজেটের আকার জিডিপির ২৫ শতাংশ হতে পারে৷ কিন্তু এখন বাংলাদেশের বাজেটের আকার জিডিপির ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ৷ অর্থনীতির সেই বিবেচনায় বাজেটের আকার বড় হয়েছে বলে মনে করেন না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ৷ আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বাজেটের আকার বড় হলেও দিন দিন বাস্তবায়নের হার কমছে৷ তাই বাজেটের আকার বড় দেখে তাকে একবারেই বড় বাজেট বলা ঠিক হবে না৷
বাংলাদেশের প্রথম দিককার বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার বাজেটের ফোকাসও যে খুব পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবে না৷ অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব বেড়েছে৷ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মনোযোগ দিচ্ছে সরকার৷ আর বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে৷ উন্নয়ন বাজেটে কমছে বিদেশ-নির্ভরতা৷ তারপরও বাজেটে এক ধরনের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেখা যায়, যা শেষ পর্যন্ত অর্জন হয় না৷ ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে না৷ বাড়েনা কর্মসংস্থান৷
সিপিডি’র অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বাজেটের একটা ফিসক্যাল ডিসিপ্লিন আছে৷ সেই ডিসিপ্লিনের দিন দিন অবনতি হচ্ছে৷ বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা থাকে তা অর্জন হয় না৷ বাজেটের সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পার্থক্য প্রতিবছরই বাড়ছে৷ গত বছর পর্যন্ত ৭৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, ২১ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি৷ আগের বছরগুলোতে ১৬ থেকে ১৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে৷
বাজেট প্রণয়নের সময় ঘাটতি ও ব্যয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়৷ আয়ের বিবেচনা অনেক দুর্বলতর অবস্থায় থাকে৷ স্বাভাবিক বিবেচনায় আয় অনুযায়ী ব্যয় করা হয়৷ কিন্তু আমাদের বাজেটে ঘাটতি এবং ব্যয় বিবেচনা করে আয় ঠিক করা হচ্ছে৷ আর এ কারণে গত এক-দুই বছরে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে আমরা অবাস্তব কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে দেখেছি৷ গত অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল ৪৩ শতাংশ৷ কিন্তু স্বাভাবিক বিবেচনায় এটা ১৫-২০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়৷
রাজস্ব বাজেটে সুদ-অসুদ এবং সরকারি বেতনভাতার পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে৷ সেটা রাজস্ব বাজেটের ব্যয়ের একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সুদ, সুদের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে৷ রাজস্ব আদায় যেহেতু লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করছে না তাই বাজেটেরই একটি অংশ আবার ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হচ্ছে৷”
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘বছরের পর বছর আমরা দেখি, যে বাজেট ঘোষণা করা হয় রিভাইসড বাজেট তার চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ কম হয়৷ ৮০ ভাগ অর্জন হয়৷ সেই বিবেচনায় আমি বাংলাদেশের বাজেটকে খুব বড় বাজেট বলতে রাজি নই৷ আর বাজেট বাস্তবায়নের গুণগত মান উন্নয়নের আমরা যে আশা করেছিলাম, তা হয়নি৷ এডিপি’র বাস্তবায়নে যে ধীরগতি তার কোনো উন্নতি নেই৷”
তবে বাংলাদেশের বাজেটে এক ধরনের সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷ কারণ, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে৷ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে৷ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা এখন বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার সাহস দেখাচ্ছি, এটা ভালো৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সাধারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের যে সক্ষমতা, তাতে আমরা এক বছরের প্রকল্প তিন বছরে শেষ করতে পারি না৷ তাই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি আমরা সক্ষমতা দেখাতে না পারি, এখানেও যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরের পর বছর লেগে যায়, তাহলে বাজেটের বড় আকার কোনো ফল দেবে না৷”
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যোগ করেন, ‘‘বাজেট এখন অনেক বেশি নীতিভিত্তিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে হচ্ছে৷ যেমন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি অথবা সরকারের বিভিন্ন খাতভিত্তিক পরিকল্পনাকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে৷ অবকাঠামো খাতকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং তার ফলে বিদ্যুৎখাতে লক্ষ্যনীয় উন্নতি হচ্ছে৷ যোগাযোগ খাতে যে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা সেই সুবিধা পুরোপুরি নিতে পারিনি৷ যোগাযোগ খাতে শুধু সড়ক নয়, রেল ও নৌপথকেও গুরুত্বের মধ্যে আনতে হবে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘উন্নয়ন বাজেটে যেসব বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, তা শেষ না হওয়ায় বাজেটের আকার বড় দেখা গেলেও প্রকল্প থেকে প্রাথমিক প্রাক্কলনে যে রিটার্ন আসার কথা, তা আসে না৷ প্রকল্পের সময় বাড়ে, অর্থ খরচ বাড়ে৷ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাঙ্খিত মাত্রায় বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না৷ কর্মসংস্থান হচ্ছে না৷ ফলে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না, বরং প্রকৃত আয় কমছে৷”
‘‘প্রকল্প যখন নেয়া হয়, ব্যয়ের হিসাব করা হয়, তখন অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়৷ দুর্নীতি হয় বা দুর্নীতির সুযোগ থাকে বলে অভিযোগ আছে৷ তাই বড় বাজেট আসলে বড় বিনিয়োগ কিনা সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷”
বাংলাদেশে এখন বাজেটে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ আরো অনেক সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়৷ এছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় দরিদ্রদের বিনামূল্যে বা কমমূল্যে খাদ্য দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ এটাকে বাজেটের একটি ইতিবাচক ‘ট্রেন্ড’ হিসেবে দেখা হয়৷ তবে এই ট্রেন্ড আরো বাড়ানো প্রয়োজন৷ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের অংশগ্রহণ খুবই ইতিবাচক৷ এবং এটা ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে৷ তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই বিনিয়োগ অনেক কম৷”
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমাদের প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ছে৷ কিন্তু এই সেফটি নেটের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরকল্যাণ ভাতাও রয়েছে৷ তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশ আলাদা করে বিবেচনা করতে হবে৷ সেটা বিবেচনা করতে গেলে দুস্থ ও গরীব মানুষের জন্য এই বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে৷ এখানে শুধু সংখ্যা নয়, পরিমাণও বাড়াতে হবে৷”
১৯৭২ সালের পর প্রথমবারের মতো বাজেট ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায় ১৯৭৪-এ৷ আর ১৯৮৮ সালে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকায়৷
২০০৩ সালে ঘোষিত ৩১তম বাজেট প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়৷ তখনকার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের পেশ করা ঐ বাজেট ছিল ৫১ হাজার ৯’শ ৮০ কোটি টাকার৷ ৫ বছর পর ২০০৮-৯ অর্থ বছরে যা ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম পেশ করেন সেই বাজেট৷
২০১১ সালের ৯ জুন পেশ করা হয় ৪১তম বাজেট, যার আকার ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১২ সালের ৭ জুন দেয়া হয় ৪২তম বাজেট৷ মহাজোট সরকারের গত মেয়াদের ৫ম ও শেষ বাজেট দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, এর আকার ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ ৯১ কোটি টাকা৷
দ্বিতীয় মেয়াদের মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেট দেয়া হয় ২০১৪ সালের ৫ জুন, যার আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫শ’ ৬ কোটি টাকা৷ ২০১৫-তে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৫ হাজার ১শ’ কোটি টাকায়৷ এরপর ২০১৬ সালে এসে এর আকার দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা৷ ২০১৭-১৮ সালে এই বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার৷
বাজেটে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে সব সময়ই বরাদ্দের দাবি বেশি থাকে৷ কারণ, এর সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন সরাসরি যুক্ত৷ কিন্তু বাংলাদেশের বাজেটে ওই দু’টি খাতকে শীর্ষে রাখা যাচ্ছে না৷ কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেয়া বেশি প্রয়োজন, কারণ, অর্থনীতিতে উৎপাদন ও সেবার ধারায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভবিষ্যতে প্রচলিত ধারার জনশক্তি খাপ খাওয়াতে পারবে না৷
ড. নাজনীন মনে করেন, বাজেটের অগ্রাধিকার খাতে পরিবর্তন আসছে৷ আইসিটিকে সময়ের সঙ্গে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে৷ তবে স্বাস্থ্য খাত আরো গুরুত্বের দাবি রাখে৷
অন্যদিকে ড. মেয়াজ্জেম বলেন, ‘‘অবকাঠামো খাতে অনেক বড় বিনিয়োগ করতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে যে বিনিয়োগ দরকার, তা করা যাচ্ছে না৷ গত দশকে যে ধরনের মানবসম্পদ দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখা হয়েছে, সামনে সেই ধরনের মানবসম্পদ দিয়ে অর্থনীতি সচল রাখা যাবে না৷ তাই সেই ধরনের মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে৷”
বাংলাদেশে এখন কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি৷ আসলে কর্মসংস্থান না বাড়লে বাজেটে যে বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়বে৷ তাই সরকারের অবকাঠামোগত বড় প্রকল্প, যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলএনজি স্টেশন এবং সরবরাহ, স্পেশাল ইকোনোমিক জোন– এগুলো দ্রুত শেষ করলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, বাড়বে কর্মসংস্থান৷- ডয়চে ভেলে বাংলা