এম কে আনোয়ারের মৃত্যুতে জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্রের শোক প্রকাশ

ঢাকা – বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি-মন্ত্রী ও কেবিনেট সচিব এবং বরেণ্য রাজনীতিবিদ এম কে আনোয়ারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠিতা চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম ।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের জন্য কাঁদছে কুমিল্লার হোমনা, তিতাস ও মেঘনাবাসী। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সোমবার দিবাগত রাত ১.২০ মিনিটে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি ছিলেন কুমিল্লার হোমনা, তিতাস ও মেঘনা উপজেলাবাসীর একজন অভিভাবক। কর্মজীবন থেকেই তিনি এলাকার উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে হোমনার চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য দল মত নির্বিশেষে সকলের কাছেই তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। তার সততা, নিষ্ঠা এবং ভালোবাসায় ছিল মানুষ মুগ্ধ। এ অঞ্চলে দীর্ঘ ২৫ বছরে রাজনৈতিতে বড় ধরণের কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯০ সালের আগে হোমনা-মেঘনা উপজেলা ছিল এক দুর্গম জনপদের নাম। দূর-দূরান্ত থেকে আসা যে কোনো চাকুরিজীবী থেকে সাধারণ মানুষের জন্য এ জনপদ ছিল এক শাস্তির দ্বীপ। এম কে আনোয়ারের নিরলস প্রচেষ্টায় পাল্টে যায় এ জনপদের চেহারা। যেখানে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস ছিল মানুষের কাছে রূপকথা। সেই রূপকথাকেই বাস্তবে পরিণত করে তিনি হয়েছেন এক কিংবদন্তি। রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন খাতে আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মানুষের আপনজন হয়ে উঠেন। এম কে আনোয়ারের মৃত্যুর খবরটি রাতের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়লে এলাকার সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। সকাল থেকেই দলে দলে লোকজন তার হোমনাস্থ বাসভবনে ছুটে আসেন। আবেগ সামলাতে না পেরে অনেকেই তার ছবি সংবলিত পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে কাঁদতে থাকেন।
সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। তার জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। পুরো নাম মোহাম্মদ খোরশেদ আনোয়ার, সংক্ষেপে তিনি এম কে আনোয়ার। তিনি ১৯৩৩ সালে ০১ জানুয়ারি কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ওপারচর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবিদ আলী ছিলেন একজন শিক্ষক। এম কে আনোয়ার পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এককালের জাদরেল সিএসপি আমলা এম কে আনােয়ার প্রশাসনিক জীবনে অবসর নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে টানা পাঁচবার কুমিল্লার নির্বাচনী এলাকা বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। খালেদা জিয়ার শাসনামলে তিনি দুবার মন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেন। সংসদে নানা বিতর্কে অংশ নিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিন জেলও খেটেছেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকারি চাকুরে হিসেবে পেশাজীবন শুরু হয় এম কে আনোয়ারের। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তার ৩৪ বছরের পেশাগত জীবনে তিনি ফরিদপুর ও ঢাকার ডেপুটি কমিশনার, জুটমিল কর্পোরেশনের সভাপতি, টেক্সটাইল মিল কর্পোরেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ বিমানের সভাপতি এবং প্রশাসনে বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন তিনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি প্রশাসনে বিভিন্ন উচ্চপদে পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিএসপি কর্মকর্তা এম কে আনোয়ার ১৯৭১ সালে ঢাকা জেলার প্রশাসক ছিলেন।
শিক্ষাজীবনে তিনি ১৯৪৮ সালে লেটারমার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন, ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিভাগে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এম কে আনোয়ার ১৯৫৬-১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছরের কর্মময় জীবনে তিনি ফরিদপুর ও ঢাকার ডেপুটি কমিশনার, জুটমিলস কর্পোরেশন, টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন, বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন সিএসপি কর্মকর্তা ছিলেন। এম কে আনোয়ার ১৯৭১ সালে ঢাকার জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব, অর্থসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা কেবিনেট সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার পেশাগত জীবনের এক সময় পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারীর অধীনেও চাকুরি করেছেন।
রাজনৈতিক জীবনে এম কে আনোয়ার যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র- তখন ছাত্র সংসদের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফজলুল হক হলের ছাত্র থাকাবস্থায় এম কে আনোয়ার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে সফলতার সাথে নৌ পরিবহন, বাণিজ্য, শিল্প, দপ্তরবিহীন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সর্বশেষ ২০০১ সালে কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি দলের একজন অন্যতম সহ-সভাপতি হন। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্যপদ লাভ করেন। ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকার ও বর্তমান সরকারের আমলে কয়েকবার কারাভোগ করেছেন।
ব্যক্তিজীবনে এম কে আনোয়ার স্ত্রী মাহমুদা আনোয়ার (শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের অনুসারী ও পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের মেয়ে), তার দুই ছেলে মাহমুদ আনোয়ার কাইজার এমবিএ- একজন সফল ব্যবসায়ী, ছোটো ছেলে মাসুদ আনোয়ার এমবিএ পাশ করে বর্তমানে আমেরিকার একটি মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট কোম্পানিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে খাদিজা আনোয়ার একজন সাবেক বিসিএস ক্যাডার।
মঙ্গলবার এক শোকবাণীতে তিনি বলেন, দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ এম কে আনোয়ারের মৃত্যুতে তার পরিবারবর্গের মতো আমিও গভীরভাবে শোকাহত ও ব্যথিত হয়েছি। আমি তার রুহের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। সজ্জন, মিতবাক, নিয়মনিষ্ঠ, কথা ও কাজে অসাধারণ সামঞ্জস্য ছিল মরহুম এম কে আনোয়ারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার সততা ও নিষ্ঠা ছিল ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। সেই কারণেই পেশাগত জীবনে সরকারি সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও তিনি তার অমলিন ব্যক্তি-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনেও তিনি নিজ আদর্শে অটল থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জনগণের সেবা করে গেছেন।
ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম বলেন, রাজরোষে পড়া সত্ত্বেও তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি, তাই বারবার কারাবরণসহ নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করেও নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সাথে অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি কখনোই কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে মাথানত করেননি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সবসময় থেকেছেন সামনের কাতারে। নিজ এলাকায় শিক্ষার প্রসার ও জনকল্যাণমূলক কাজেও তার অবদান স্মরণীয়। তাই জনগণের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কারণেই আদর্শনিষ্ঠ এম কে আনোয়ার বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনকে বুকে ধারণ করে এম কে আনোয়ার স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারে বিএনপিকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে যখনই গণতন্ত্র বিপদাপন্ন হয়েছে তখনই স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দেশের উন্নয়নের জন্য এমকে আনোয়ারের গৌরবময় অবদান দেশবাসী ও বিএনপি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তার মৃত্যু জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য মর্মস্পর্শী। এম কে আনোয়ারের মৃত্যু দেশবাসী ও দলের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ, গুণগ্রাহী, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।