খোমেইনী্র গড়া আদর্শ রাষ্ট্র ইরান ধর্ম ও গনতন্ত্রের মিশ্রণ

মোস্তফা কামাল মজুমদার
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মহান ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনীর ২৯তম ওফাত বার্ষিকীতে একটা কথাই বারবার মনে ভেসে আসে। পশ্চিমা বিশ্বের এতো বিরোধিতা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ সত্বেও ইরান মাথা উঁচু করে উন্নয়নের পথে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছে। এবছর ইরান-বিপ্লবের ৩৯তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন ইরানকে হিসেব করে চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে গেলেও জাতিসংঘের বাকি চার ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধর নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য এবং জার্মানি তা রক্ষা করা এবং মেনে চলার ব্যাপারে আগের চেয়ে আরো বেশি আগ্রহী। সাধারণের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, ইতিহাসে বর্ণিত প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের ভীত হিসেবে খ্যাত ইরানের এই স্থিতাবস্থা এবং শক্তির উৎস কি?আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনীর চিন্তাধারার প্রভাবের ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে তাঁর সময়, পরিপার্শ্বিকতা ও প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় আনতে হবে। দুনিয়ার এই প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরানে রয়েছে হাজার বছরের ইসলামি ঐতিহ্য। শেখ সাদী ও জালালুদ্দিন রুমীর মতো কবি দার্শনিক মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্ব ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়াকে আলোকিত করে রেখেছেন শতশত বছর ধরে। ইরানেই তৈরি হয়েছে হাফেজ সিরাজ, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়ামের মতো মহাকবি-চিন্তাবিদ। সারা দুনিয়া তাঁদের আধুনিক এবং মানবীয় চিন্তাধারার মূল্যায়ন করছে নতুন করে। ইরানের সাংস্কৃতিক প্রভাব এই বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে এতই প্রবল যে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা লেখা হয়েছিল ফারসিতে। ভারতে কোর্টের ভাষা হিসেবে ফারসিকে ইংরেজরা তাদের সুবিধার জন্য পরবর্তীকালে বাদ দেয়। কিন্তু এই উপমহাদেশের আলেম সমাজ এখনো বিখ্যাত ইরানি কবিদের উদ্ধৃতি তাদের বয়ানে ব্যবহার করেন। ইমান খোমেইনী সেই ঐতিহ্যের ধারক।
ইমাম খোমেইনী তাঁর আন্দোলনের প্রথম দিকে শাহ রেজা পাহলভির শাসনামলে ইরানকে পশ্চিমা শক্তির নির্দেশে পরিচালনার বিরোধিতা করেন। রাজনীতিতে আদর্শবাদিতা প্রবর্তনের জন্য সামাজিক বিভিন্ন পর্যায়ে যখন ইরানের ধর্মীয় নেতারা কাজ করছিলেন ঠিক তখনি, ইরানের শাহ তাঁদের আন্দোলনকে শাণিত করার মতো জনমত তৈরির সুযোগ এনে দেন। ১৯৬২ সালে শাহের সরকার কর্তৃক পাশ করা জেলা পরিষদ আইনে নির্বাচনে প্রার্থিতা এবং নির্বাচিতদের শপথের বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তার ফলে প্রার্থীদের মুসলমান হতে হবে এবং কোরানের শপথ নিতে হবে, এই বিধানগুলো বাদ পড়ে। উল্লিখিত বিধানের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আলেমদের আন্দোলনে তিন মাসের মাথায় রেজা পাহলভি এই আইন বাতিল করতে বাধ্য হন।
ইমাম খোমেইনী ধর্মীয় পণ্ডিতদের নিয়ে কোম শহরে নিয়মিত পর্যালোচনা বৈঠন শুরু করেন। খোমেইনীর নেতৃত্বের নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রচলিত সরকারের বিরূদ্ধে সমালোচনাকে তিনি রেজা শাহ পাহলভির বিরুদ্ধে সমালোচনায় পরিণত করেন। তার সাত বছর পর ১৯৬৯ সাল থেকে ইমাম খোমেইনী ইরাকের নাজাফে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করার সময় ইসলামি সরকার গঠনের ধারণা ‘বেলায়েত-ই-ফাকিহ’ সম্পর্কিত বক্তৃতামালা উপস্থাপন করেন। তাঁর মূল কথা ছিল ইসলামি আইনজ্ঞদের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার, ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা, এবং আদর্শকে ধর্মকর্মের মতো গুরুত্ব দেয়া। তিনি চিন্তাবিদ ও বিষেশজ্ঞদের এই ধারণার ওপর বিষদ বিচার-বিশ্লেষণের আহ্বান জানান এবং তা ইরান এবং ইসলামি দেশসমূহে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
তাঁর এই নতুন চিন্তাধারা ইরানের অন্যান্য ধর্মীয় নেতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্য সম্প্রসারিত হয়। তা নিয়ে ছাত্র-জনতার মধ্য গড়ে ওঠে এক ধর্মীয় পুনর্জাগরণ, যা ১৯৭৯ সালে সংঘটিত বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে। ১৯৬২ সালে রেজা পাহলভির নিরাপত্তা বাহিনী ইমাম খোমেইনীকে তাঁর শাহবিরোধী বক্তব্যের অজুহাতে গ্রেফতার করে এবং দুই বছর পর তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। প্রথমে তুরস্ক, পরে ইরাক এবং সর্বশেষ ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন যাপনের সময় তিনি ইরানে শাহকে উৎখ্যাত করার জন্য তাঁর অনুসারীদের আহ্বান জানান। গ্রেফতার করার পর ইমাম খোমেইনীর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় এবং তাঁকে জনগণ জাতীয় বীর হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। শাহবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয় এবং ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে ক্ষমতায় রেখে শাহ তাঁর পরিবারবর্গ নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান।
ইমান খোমেইনী বীরের বেশে ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন। ফেরার পর ১৯০৬ সালে প্রণীত সংবিধান সংশোধনের জন্য বিশেষজ্ঞদের আ্যসেম্বলি ডাকেন। তাঁর দেয়া দিক-নির্দেশনার ভিত্তিতে সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন এনে তা ১৯৭৯-এর জুলাই মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে চালু করা হয়। সে বছরের ডিসেম্বরে এক গণভোটে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ইমাম খোমেইনী ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন, যা ছিল দুনিয়ার প্রথম ইসলামি প্রজাতন্ত্র। তাঁকে আজীবন ইরানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু টানা আড়াই হাজার বছরের স্বাধীন সভ্যতা এবং ঐতিহ্যের ধারক ইরানের এই নেতা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার কথা ভোলেন নি। নিজে ক্ষমতা কুক্ষিগত না করে বাস্তবভিত্তিক চিন্তার ফসল হিসেবে খোমেইনী নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। তাঁর উত্তরসূরি এবং রাহবার হিসেবে খ্যাত আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী এখন তাঁর আসন অলংকৃত করে পথপ্রদর্শক হিসেবে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এখানে বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশের অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ মনে করেন তদানীন্তন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে প্রচলিত সংবিধান ছিল বিশ্বের প্রথম আধুনিক ইসলামিক সংবিধান। তাতে উল্লেখ ছিল, কোন আইন বা বিধান ইসলামি শরিয়ত-বিরোধী হলে তা বাতিলযোগ্য হবে। অবশ্য দুই বছর পরেই ঐ সংবিধান পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাতিল করে দেয়। মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট আলাদা এই রাষ্ট্রের সংবিধানে ইসলামি শরিয়াবিরোধী আইন না করার বিধান ছিল আবেগপ্রসূত, কোন ধারাবাহিক আন্দোলন বা চিন্তাধারার প্রতিফলন নয়। ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির পেছনে রয়েছে ধারাবাহিক ইসলামি সংস্কৃতি এবং সচেতনভাবে গড়ে তোলা আন্দোলন। ইমাম খোমেইনী ছিলেন তার সুদক্ষ নির্মাতা।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরের বছরই শাত-ইল আরব নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে ইরাকের সাথে যুদ্ধ বেধে যায়। আট বছরের এই যুদ্ধে ইরাকের তখনকার প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন প্রবল পরাক্রমশালী পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় বলিয়ান হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হন। এই যুদ্ধে বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের আত্মরক্ষার শক্তি এবং ইরানি জনগণের ঐক্য প্রতিফলিত হয়। সেই ঐক্য বজায় রাখার কৃতিত্ব ছিল আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর। কারণ, তাঁর নেতৃত্বে ইরানের জনগণ ছিল ঐক্যবদ্ধ।
আদর্শ-বিচ্যুত বিশ্বে এখন চলছে চিন্তার নৈরাজ্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নতুন সমীকরণ। নগদ প্রাপ্তির এবং ভোগের যে আধুনিকতা-পরবর্তী ধ্যান-ধারণা প্রচলিত আছে তাতে কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা যাচ্ছে না। বর্তমান প্রজন্মের মানুষেরা এক অর্থে ভাগ্যবান। বিশ্বসভ্যতার এক ক্রান্তিকালে তাঁরা বসবাস করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে অতীতের সব চিন্তা-ভাবনা একের পর এক চুরমার হয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। সনাতন চিন্তা এবং তার ধারকরা এত দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে যে, কারো কোন কথার ওপর শেষ ভরসা করা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। এখন বিশ্বে একক বা দুই মেরুর নির্দিষ্ট নেতৃত্ব নেই। অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির মাধ্যমে ক্ষমতাধর আরো একাধিক দেশ বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে ভূমিকা রাখতে সক্ষম এবং আগ্রহী। সবকিছু নতুন ভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। কাজেই এখনকার প্রজন্ম কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকছে না। সবকিছু নিজের করে দেখার এবং ভাবার সুযোগ পাচ্ছে।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে, সারা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদের চিন্তাধারায় এক বিরাট পরিবর্তন আসে। তার ঢেউ বাংলাদেশেও এসে লাগে। বহুদিনের গড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। এমনকি পার্টির অফিসও দুইভাগে বিভক্ত করে নেন ভিন্ন মতাবলম্বীরা। গণচীন বা ভিয়েতনামে এখন আগের ধাঁচের সমাজতন্ত্র নেই। উভয় দেশে কমিউনিস্ট পার্টির একক শাসন বজায় রেখে ব্যক্তি মালিকানা এবং ব্যক্তি পুঁজির পথ খুলে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বে, পুজিঁবাদী বস্তুবাদের পতন পরিলক্ষিত হয় ২০০৮ সালে যখন আমেরিকার কংগ্রেস ৭০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে সেদেশের পতনোম্মুখ ব্যাংক, লিজিং কোম্পানিগুলোকে রক্ষা করে। ব্যাংক এবং হাউজিং ফিনান্স কোম্পানিগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে মানুষ গড়ে তোলে ওয়াল স্ট্রীট দখল আন্দোলন। বেশি মুনাফা লাভের জন্য স্পেকুলেশন এবং স্পেকুলেটিভ মুনাফার ওপর সুযোগ সুবিধা ভোগের কারণে প্রধানত দেউলিয়া হয়ে পড়া ব্যাঙ্ক ও লিজিং কোম্পানিগুলো বল্গাহীন পুঁজিবাদের দুর্বলতা ফুটিয়ে তোলে। পুঁজিবাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে নব্য-উদারনৈতিক চিন্তাধারার উত্থান লক্ষণীয়। কিন্তু টেকসই কোন দর্শন বা সমাজব্যবস্থা তার ওপর এখনো গড়ে ওঠে নি।
বিগত দুই বছর ধরে দেখা গেছে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নেয়া অবস্থান, বর্ণবাদী শাসনের আবহ সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া তার মধ্যে অন্যতম। পুঁজিবাদি বিশ্বের এতদিনের নেতা এবং বিশ্বায়নের প্রধান প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আন্তর্জাতিক সকল কার্যক্রম থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। মুক্তবাজার, মুক্তবাণিজ্য এবং উন্নত দেশের বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর দাপট বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরো বঞ্চিত করে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেও অভ্যন্তরীণ সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং গণচীন যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছে।
খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদগণ এই পরিস্থিতির জন্য সামাজিক দায়-দায়িত্বহীন একতরফা মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদকে দায়ী করেছেন। ইরানে আদর্শভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার ৩৯ বছরের অব্যাহত অগ্রগতি বিশ্ব পরিস্থিতির নিরিখে বিচার করলে অবশ্যই ব্যতিক্রমধর্মী মনে হবে। ৯/১১ পরবর্তী বিগত দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রচারণা হয়েছে, তাতে এ কথা মনে করা কি বেঠিক হবে যে, শক্তিধররা ইসলামি যেকোন কিছুকেই খারাপ বলতে চেষ্টা করছে। তারা স্বীয় দেশ থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলছে। এখন চরমপন্থী কার্যকলাপের জন্যও এককভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের দায়ী করছে।
ইমান খোমেইনী ইরানে একটা আদর্শ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। ইসলামি আইনজ্ঞদের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের যে ধারণা তিনি শুরু থেকে দিয়েছেন, তাকে গ্রীক দার্শনিক প্ল্যাটোর আদর্শ রাষ্ট্র-চিন্তার সাথে তুলনা করা যায়। প্ল্যাটো বলেছেন, দেশ চালাবেন দার্শনিক রাজা। ইমাম খোমেইনী ইসলামি আইনজ্ঞদের অভিভাবকত্বে তথা নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার সৃষ্টি করে জনগণের নির্বাচনে গঠিত সরকার-ব্যবস্থা চালু করেছেন। ইরানের সংবিধানে অভিভাবক পরিষদ এবং সুপ্রিম নেতার ব্যবস্থা থাকলেও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সরকার পরিচালনায় প্রচুর স্বাধীনতা রয়েছে। একইভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট আইন প্রনয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে কাজ করে। কোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট ও অভিভাবক পরিষদের মধ্যে মতপার্থক্য হলে তা দূর করার জন্য রয়েছে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। কাজেই সুপ্রিম নেতা হিসেবে ইমাম খোমেইনী বা বর্তমানের রাহবার ইমাম আলী খামেনেয়ী এককভাবে ইরান শাসন করছেন এ কথা কেউ বলতে পারবেন না।সাথে সাথে ইরানে মানুষের সৃজনশীলতাকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। শত অবরোধ সত্ত্বেও ইরানের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, পরমাণুবিজ্ঞান ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা মানুষের সৃজনশীলতারই বহিঃপ্রকাশ।
ইমাম খোমেইনী বিশ্বাস করতেন ইসলামি বিপ্লব মানব কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাস করতেন এবং বলে গেছেন, ঐক্যের মাধ্যমে মুসলমানরা দুনিয়ায় ক্ষমতার ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী পশ্চিমা শক্তির মোকাবেলা করবে। ইমাম খোমেইনী বিশ্বব্যাপী ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে তাঁর বিপ্লবের লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলাম এসেছে শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, জগতের সকল মানবগোষ্ঠীর মঙ্গল ও মুক্তির জন্য। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের সময়কে (১২-১৭ রবিউল আউয়াল) ঐক্যের সপ্তাহ এবং রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে তিনি আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস ঘোষণা করেন।
পরিতাপের বিষয়, মুসলমান দেশসমূহকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত ও দুর্বল করে তাদের হাজার বছরে অর্জিত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার যে প্রক্রিয়া উপনিবেশ আমলে শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত আছে। ইসলামি আদর্শবিচ্যুত উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থসহ মদদ দিয়ে ইসলামি জাগরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। সচেতন মুসলিম চিন্তাবিদদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেতারা অনেকেই তা অনুধাবন করতে পারছেন না। সাধারণ উম্মাহর একান্ত ইচ্ছা উল্লিখিত বাধা অতিক্রিম করে মুসলিম দেশগুলো জাগরণ ও ঐক্যের পথে এগিয়ে আসবে।
যাঁরা ইমাম খোমেইনীর আদর্শকে খাটো করে দেখতে চেষ্টা করেন, তাঁরা আরো খতিয়ে দেখতে পারেন। তাঁর জ্ঞানের বিশালতা, বিচারবুদ্ধির তীক্ষ্ণতা এবং প্রখরতা প্রতিটি কাজে ফুটে ওঠে। সু্যোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার মসনদে না বসা, ইরানে একটা গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা তার অন্যতম। ক্ষুদ্র চিন্তার কোন নেতা মুসলমানদের দ্বিতীয় পবিত্রতম মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার জন্য প্রতি রমজানের শেষ শুক্রবার আল-কুদস দিবস পালনের ডাক দিতে পারেন না। এই দিবস এখন সকল মুসলিম দেশে পালিত হয়। ইরানের আদর্শে অনুপ্রাণিত লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলী বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে প্রমাণ করেছে, আদর্শভিত্তিক ঐক্যের মাধ্যমে পার্থিব সবকিছুই অর্জন সম্ভব।অনেক অপপ্রচার সত্ত্বেও পশ্চিমা কট্টর সমালোচকরা ইরানের শাসনব্যবস্থাকে ধর্ম ও গণতন্ত্রের মিশ্রণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আমার বিশ্বাস ইরান সম্পর্কে ভ্রান্ত প্রচারণার দিন শেষ হয়ে আসছে। আদর্শে, জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে ইরান তার অতীত স্বর্ণযুগের মতো মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
(মোস্তফা কামাল মজুমদার অনলাইন দৈনিক গ্রীনওয়াচ ঢাকা পত্রিকার সম্পাদক এবং ইংরেজি দৈনিক এশিয়ান এজ পত্রিকার পরামর্শক সম্পাদক। লেখাটি তিনি বিগত ১ জুন ইরানের নেতা ইমাম খোমেইনীর ২৯তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ডেফোডিল ইউনিভার্সিটিতে ইরান কালচারাল সেন্টার আয়োজিত সেমিনারে মুল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপন করেন।)