ঢাকা, ৩০ আগষ্ট – বাংলাদেশ এবং ভারতকে অবশ্যই যৌথ নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে উৎস থেকে সাগর পর্যন্ত প্রবাহমান রেখে সার্বজনিনভাবে মেনে নেয়া অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ফর্মূলা বেছে নিতে হবে।এবিষয়ে দুই দেশের নেতারা তাদের নিজনিজ দেশের পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে নিশ্চিত হয়ে এই ফর্মূলা গ্রহন এবং বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মৈত্রিবন্ধন আরো জোরদার করতে পারেন। আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন এবং নদীও পানি অধিকার পর্যবেক্ষণ গ্রুপ, আইএফসি, আজ এক বিবৃতির মাধ্যমে এই পরামর্শ দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড জয়শংকর সম্প্রতি বলেছেন বাংলাদেশ ও ভারত ৫৪টি যৌথ নদীর পানিবন্টনের জন্য পারষ্পরিকভাবে গ্রহনযোগ্য ফর্মূলা খুঁজছে। তিনি তিস্তার ইস্যু সমাধানের ব্যাপারে ভারতের দেয়া আশ্বাস পুনরোল্লেখ করেন।
আইএফসি (আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি) নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি উভয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত কতৃক নদীগুলোকে ‘জীবন্ত স্বত্বা’ ঘোষণার বিষয় উল্লেখ করে বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশ আইনগত ও নৈতিক দিক থেকে যৌথ নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে ওয়াদাবদ্ধ।
দুই দিনের ঢাকা সফরশেষে ড জয়শংকর ২১ আগষ্ট সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা পারষ্পরিক ভাবে গ্রহনযোগ্য ৫৪টি নদীর পানিবন্টনের ফর্মূলা খুঁজে পাবার ব্যাপারে অগ্রগতির জন্য অপেক্ষা করছি’। তিনি আরো বলেন এব্যাপারে তাঁরা যেখান থেকে সম্ভব কাজ শুরু করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
আইএফসি নেতৃবৃন্দ বলেন, এমন একটা সদিচ্ছার প্রেক্ষাপটে বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের নেতাদের উচিত অতীতের উভয় দেশের সীমান্তে পানিবন্টনের ভ্রান্ত ধারণা পরিহার করে সার্বিক এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিবেচনায় উপরে উল্লেখিত ফর্মূলা গ্রহন করা। কারণ সীমান্ত রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট, কিন্তু নদীপ্রবাহ প্রাকৃতিক।
তাঁরা বলেন নদী প্রাকৃতিক স্বত্বা। উপমহাদেশের নদীগুলো এখানকার দেশগুলোর পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীবন ও জীবিকার প্রধান নিয়ামক। এই নদীগুলোকে সীমান্তে ভাগাভাগি করা যায়না। ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি তা প্রমান করেছে, কারণ চুক্তিতে নির্ধারিত হিস্যা অনুসারে পানি ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশে আসছে না।
বিশেষজ্ঞদের উদৃতি দিয়ে আইএফসি নেতৃবৃন্দ বলেন, বেঁচে থাকার জন্য নদীগুলোর বক্ষে ঐতিহাসিক প্রবাহের ন্যুনতম ২০ ভাগ পানি শুষ্ক মৌসূমে প্রবাহমান থাকা উচিত। বর্ষা মৌসূমে প্রবাহ যথেষ্ট পরিমানে থাকা উচিত যেন পরবর্তি শুষ্ক মৌসূমে পানীয় হিসেবে এবং বিভিন্ন উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের জন্য পরিমিত পানি ভূগর্ভে পূনর্ভরণ হয়।
বাংলাদেশের উৎস হিমালয়ের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে পলিমাটি বয়ে এনে পৃথিবীর এই সর্ব্বৃহত বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে। প্রাকৃতিক এক প্রবাহগুলোর উপর বাংলাদেশের জীবন এবং জীবিকা নির্ভরশীল। গঙ্গা-নির্ভর এলাকা বাংলাদেশের রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে নদীর প্রবাহ অব্যাহতভাবে কম থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এবং এসব এলাকায় আয় প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। হুমকীতে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবন। এসব এলাকার মানুষ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে টেকসই জীবন ধারণ করতে না পারলে, অন্যত্র আয়ের সন্ধানে ছুটতে বাধ্য হবে।
আইএফনি নেতৃবৃন্দ বলেন, এদেশের মানুষ শান্তিতে সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারলে বাংলাদেশ থেকে কাজের খোঁজে আসা মানুষের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য কাঁটা তারের বেড়া লাগবেনা।
উভয় দেশের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইএফসি নেতৃবৃন্দ বলেন, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ থেকে সরিয়ে পানি শুষ্ক এলাকায় প্রবাহিত করলে নদী মরে যায়। প্লাবনভূমি বর্ষাকালে নদীর প্রবাহ থেকে পানি পায় আবার শুষ্ক মৌসূমে প্লাবনভূমি থেকে চুইয়ে নামা পানি নদীকে জীবন্ত রাখে। অন্যদিকে শুষ্কভূমি শুধু নদীর পানি শুসে নেয় এবং কালক্রমে নদী মরে যায়।
কাজেই, দুনিয়াব্যাপী নদীব্যবস্থাপনার সর্বশেষ রীতি হচ্ছে ইতোপূর্বে নির্মিত ড্যাম ও ব্যারেজ তুলে নিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা। যেন নদীগুলো শুধু বর্তমান প্রন্মের চাহিদাই মেটায় না, ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা মেটানোরও উপযোগি থাকে। আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানে হাজার হাজার বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার সুফল পাওয়া গেছে। মধ্য এশিয়ার এককালের শুকিয়ে যাওয়া আমু দরিয়া আবার তার প্রবাহ ফিরে পেয়েছে। পৃথিবীর অন্যত্র অতীতের যে ভুলগুলো শোধরানো হচ্ছে সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশ, ভারত এবং উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ করতে পারেনা।
তাঁরা বলেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরাম, ওয়ার্ল্ড ওয়াটার পার্টনারশিপ, জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ কার্যক্রম এবং ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি নদীর টেকসই ও অববাহিকা ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতকে নিছক সীমান্তে পানি ভাগাভাগির চিন্তা পরিহার করে অবশ্যই এই সুচিন্তিত পানি ব্যবস্থাপনার ফরমূলা গ্রহন করতে হবে। কারণ তা নাহলে প্রকৃতির দান নদীগুলো মরে যাবে এবং এখনকার জীবন জীবিকার উপর নেমে আসবে বড়রকমের বিপর্যয়।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন আইএফসি, নিউ ইয়র্ক-এর চেয়ারম্যান, আতিকুর রহমান সালু, মহাসচিব, সৈয়দ টিপু সুলতান, আইএফসি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমাদ, সিনিয়র সহ-সভাপতি ড এস আই খান এবং আইএফসি সমন্বয়ক মোস্তফা কামাল মজুমদার।