দেশের প্রথম কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সমৃদ্ধ জাতীয় প্রেস ক্লাব লাইব্রেরী

মোস্তফা কামাল মজুমদার
নতুন সদস্যরা জেনে আনন্দিত হবেন, আমাদের সবার প্রিয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইমেইল ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হয় জাতীয়ভাবে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হবার দুই বছর আগে ১৯৯৪ সালে। তার আগের বছর সেখানে কম্পিউটার সংযোজিত করে লাইব্রেরীকে সমৃদ্ধ করা হয়। সাংবিদকরা সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের খবর সবার আগে জানান দেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব লাইব্রেরীও সেকাজটাই করেছে। এখন এই ক্লাবে একটা মিডিয়া সেন্টার আছে যা ২৫ বছর আগে স্থাপিত ইমেইল-ইন্টারনেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ।জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইন্টারনেট সংযোগ লাগার আগে ঢাকা থেকে যে সাংবাদিকগন বিদেশী সংবাদপত্র বা সংবাদসংস্থা, রেডিও বা টেলিভিশনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন, তাদের কাজের সুবিধার জন্য টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড একটা বুথ স্থাপন করেছিল। ভবনের দোতলায় ক্লাব সাধারণ সম্পাদকের রুমের ঠিক পশ্চিমাংশে। ক্লাবে ইমেইল-ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের পর এই টিআন্ডটি বুথটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়, কারণ বিদেশী সংবাদদাতারা সবাই ক্লাবের লাইব্রেরীতে স্থাপিত ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা ব্যবহার করতে শুরু করেন। ইমেইলের মাধ্যমে তাঁরা দ্রুত, নির্ভুল্ভাবে বার্তা প্রেরন করতে সক্ষম হন। তার আগে টিআন্ডটির টেলেক্সই ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি বার্তা প্রেরণের এই মাধ্যম আবহাওয়া এবং যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে মাঝেমধ্যে ঝামেলা করত। কখনো কখনো বার্তার কপি গার্বল হতো। আবার কখনো কোন লেখা ছাড়া সাদা কাগজ বেরিয়ে আসত। এবং বার্তা প্রেরককে পুনরায় বার্তা পাঠাতে হতো। সঠিকভাবে বার্তা পৌচেছে কিনা তা নিশ্চিত হবার আগে কাজ শেষ হতনা। কিন্তু ইমেইলে বার্তা পাঠালে এরকম অনিশ্চয়তার কোন কারণই নেই। বার্তা নির্ভুল্ভাবে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
মজার ব্যাপার হল, লাইব্রেরীতে ইমেইল সংযোগ স্থাপনের আগে এবিষয়ে আমাদের মধ্যে ধারণা ছিল খুবই সীমিত। কাজেই তার উদ্যোক্তা বর্তমান লেখক খুব বেশী সহিযোগিতা সহকর্মিদের কাছে পাননি। তখন ক্লাবের সভাপতি ছিলেন ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে খ্যাত জনাব হাসান শাহবিয়ার। তিনি একাজের প্রস্তাবে সাড়া দেন এবং ক্লাবের ম্যানেজং কমিটিতে তা গৃহিত হয়। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শওকত মাহমুদ। তিনি প্রকল্পটা বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। ক্লাবের কাজের জন্য ইতোমধ্যে সংগৃহীত কিছু ভাল কাঠ, লাইব্রেরীয়ানদের বসার কাউন্টার নির্মানের জন্য ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু নতুন ধরণের একাজ করতে যে টাকার প্রয়োজন তার সংকুলান করার সক্ষমতা ক্লাবের ছিলনা। বিদেশী সহায়তায় দ্রুত লাইব্রেরী সম্প্রসারণ ও কম্পিউটার সমৃদ্ধকরিণের কাজ সম্পন্ন করা হয়। টাকার যোগান দেয় নরওয়ের উন্নয়ন সংস্থা নোরাড। প্রকল্পটির অর্থায়ন আসে তাদের গনতন্ত্র শক্তিশালীকরণ কর্মসূচি থেকে। সেখানে কর্মরত অফিসার জামাল মাহমুদ এব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করেন। তার আগে নোরাড বাংলদেশের কোন লাইব্রেরী উন্নয়নের কাজে সহায়তা দেয়নি।
উল্লেখ্য লাইব্রেরী উন্নয়ন ও কম্পিউটার সমৃদ্ধকরণের একাজে সিংহভাগ বাজেট খরচ হয় কমপিউটার সংগ্রহে। একটা আইবিএম ব্রান্ড কমপিউটার কেনার কাজেই লেগেছিল তিন লাখ টাকা। প্রায় এক লাখ টাকায় আরেকটা ক্লোন কম্পিউটার কেনা হয়। আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটারএর মনিটরটা এখনো ব্যবহারে আছে। পরে বৃটিশ হাইকমিশন একটা ৩৮৬ এবং একটা ২৮৬ কম্পিঊটার অনুদান হিসেবে প্রদান করে। এগুলো বেশ কাজে লেগেছিল। বিদেশী সংবাদদাতারা তাদের নোটবই, সাইডব্যাগ কাউন্টারের টেবিলে লাইন করে রেখে তাদের ইমেইল ব্যবহারের সিরিয়াল নির্ধারণ করতেন। এই অবস্থার উন্নয়নের জন্য চারটি কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে একটা লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN) তৈরী করা হয়। তখন থেকে বিদেশি সংবাদদাতারা একাধিক টার্মিনালে বসে বার্তা তৈরী ও প্রেরণ করতেন। তাদের কাজে সহায়তা করতো তখনকার লাইব্রেরী এসিষ্টান্ট মোস্তাক। মোস্তাককে লাইব্রেরীতে কমপিউটার সংযোজনের আগেই একটা সংস্থা থেকে ট্রেনিং করিয়ে আনা হয়। তার কাজ দেখে দেখে পরে অন্য লাইব্রেরী এসিষ্টান্ট আলাউদ্দিনও কিছুটা পারঙ্গম হয়ে ওঠে। তবে প্রথম দিকে সে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একজনের কনফিডেন্সিয়াল বার্তা এই নেটোয়ার্কের সকল সদস্যের আকাউণ্টে ছড়িয়ে দেয়। ক্লাবের কিছু সদস্য যারা প্রথম দিকে এই ইমেইল সংযোগ স্থাপনের কাজে সহযোগিতা করেননি তারাই পরে তার সবচেয়ে বেশি সুবিধা গ্রহন করেন। একজন এই সংযোগের বদৌলতে সারা দুনিয়ার সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে পরে ফ্রিকোয়েন্ট ট্রাভেলারে পরিণত হয়েছেন। আরেকজন তার বিদেশে অধয়নরত সন্তানকে প্রত্যেকদিন বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যমে আদরের বাঁধনে বেঁধে রেখেছেন।
কিন্তু ইন্টারনেট জাতীয়ভাবে চালু হবার আগে কিভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাব লাইব্রেরীতে ইমেইল-ইন্টারনেট সংযোগ আসল? ১৯৯৪ সালে স্যাটেলাইট সংযোগের মাধ্যমে একটা লাইন আনে মাহবুব আলমের দ্রীক গ্যালারী। সেখান থেকে কিছু বিদেশী সংস্থা ও এনজিও সংযোগ নেয়। তখন বাংলাদেশ সরকার এবং এমসিসিআই, ডিসিসিআই, এফবিসিসিআই-সহ বড়বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেরও ইন্টারনেট সংযোগ ছিলনা। জাতীয় প্রেস ক্লাব দ্রীক গ্যালারীর কাছ থেকে একটা ডায়াল-আপ সংযোগ আনে। তখনো টিআন্ডটি টেলিফোন লাইনের অনেক চড়া দাম। ক্লাবের দুইটি লাইনের একটি এখানে লাগানো সম্ভব ছিলনা। কারণ তাহলে ক্লাবের কাজ ব্যাহত হবে। আবার ঢাকার সেন্ট্রাল এক্সচেঞ্জের ক্যাপাসিটি অবশিষ্ট ছিলনা। দেন দরবার করে লাইব্রেরীর জন্য পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় একটা লাইন আনা হয়। সেটি দিয়েই ডায়াল-আপ সংযোগ স্থাপন করা হয় ইমেইল ইন্টারনেট লাইন। ল্যান্ড লাইনটা এখনো লাইব্রেরীতে ফ্যাক্স আদান প্রদানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইমেইল সংযোগ আনার জন্য খরচ হয়েছিল ১২,০০০ (বারো হাজার) টাকা। ১৯৯৪ সালে ক্লাব সভাপতি ছিলেন রিয়াজুদ্দিন আহমেদ। সম্পাদক পদে শওকত মাহমুদ বহাল ছিলেন। ইন্টারনেট সংযোগ আনার কাজে ক্লাবের ফান্ড থেকে কোন টাকা পাওয়া যায়নি। ক্লাবের ১২ জন মহৎ সদস্যের চাঁদার টাকায় এই সংযোগ আনা হয়। তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল এই চাদা প্রদানের বিনিময়ে তাঁরা কম্পিউটার ক্লাবের সদস্য হবেন এবং তা ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, মরহুম সায়্যিদ আতিকল্লাহ, মুজাফফর হোসেন মানিক, রউফুল হাসান, জয়নুল আবেদিন (জং), মঈনুদ্দিন নাসের, শেহাবুদ্দিন আহমেদ নাফা, সালিম সামাদ, মোস্তফা কামাল মজুমদার প্রমুখ। আইএসএন আরম্প্রকাশ করলে তার নির্বাহী সনামধন্য হলিদে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খানের কাছ থেকে বিনে পয়সায় আরেকটী এমেইল সংযোগ আনা হয় এবং ব্যয় বহুল দ্রীকের সংযোগ কালক্রমে বন্ধ হয়েযায়।
প্রথম দিকে ইমেইল ব্যবহারের জন্য মাসে ৩০০ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করে হয়েছিল। পরবর্তিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ এই চাঁদা তুলে দেন। ইমেইল, ইন্টারনেট সাধারণের মধ্যে এতই অপরিচিত ছিল যে উদবোধনের দিন সবার অপ্রস্তুত চেহারা দেখে বর্তমান লেখক মোস্তাককে সাথে নিয়ে এবিষয়ে এক পৃষ্ঠা এমেইল ইন্টারনেট-এর ব্যাখ্যা লিখে সবার মধ্যে বিতরণ করেন। প্রধান অতিথি মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম এবং অন্য সবার মুখে স্বস্তির ভাব ফুটে ওঠে। ঐ অনুষ্ঠানের বক্তৃতা এবং পরেরদিন ছাপানো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো তথ্য সমৃদ্ধ হয়। এখন তা ভাবলে বিশ্বাস হয়না। অনুষ্ঠানের পর ইমেইল ব্যবহারের চাহিদা বাড়ে। দৈনিক সংবাদের তৎকালীন সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল জানতে চান এই ইন্টারনেটের লাইন তার পত্রিকায় নেয়া যাবে কিনা। তবে তখনো কেউ কেউ এই কমপিউটারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছিলেন সন্দিহান। একজন না জেনে মন্তব্য করেন, ‘কোন আহাম্মক লাইব্রেরীতে কম্পিউটার স্থাপন করেছেন।‘ আরেকজন বলেন, এই সব কম্পিউটার মুখ থুব্রিয়ে পড়বে। উভয়েই লাইব্রেরী কমিটির আহবায়ক হয়ে পরে তার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এবং উন্নয়নের জন্যও কাজ করেন। দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের সিটি এডিটর ফাজলে রশীদ ইউসুফ জামাল আহাদ এই লেখককে বলেন, তুমি এটা কি করেছ। তার মর্মকি সবাই বুঝবে? একজন বেসরকারী উদ্যোক্তা নিয়ে বাইরে স্থাপন করলে ব্যবসায়িকভাবে সফল হত এবং জীবনের জন্য একটা আসেট হয়ে থাকত। তিনি ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। তার দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) আইএসএন জন্ম নেয় যা এখনো ব্যবসায়িক ভাবে সফল হিসেবে টিকে আছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে কম্পিউটার সমৃদ্ধ লাইব্রেরী উদবোধন করেন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ।
কম্পিউটার স্থাপনের পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী সায়েন্স বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রুপে গ্রুপে ছাত্ররা শিক্ষকদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার সমৃদ্ধ লাইব্রেরী দেখতে আসত। লাইব্রেরী এসিষ্টান্ট মোস্তাক গর্ব করে তা তাদের কাছে ব্যাখ্যা করত। এই অভুতপূর্ব উন্নয়নের আগে লাইব্রেরী ১৩টা কাঠের তৈরী আলমিরাতে রক্ষি্ত বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাকায় প্রকাশিত এবং দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে প্রেরিত পত্রপত্রিকাগুলো প্রত্যেকটির মাসিক ফাইল সুতায় বেঁধে টাল দিয়ে রাখা হত। মাস শেষ হবার আগেই অনেক পত্রপত্রিকার পাতা ছিঁড়ে যেত। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং বিদেশ থেকে আসা পত্রিকার জন্য লাইব্রেরীর ভিতরে এবং জেলা থেকে প্রেরিত পেপারের জন্য বাইরে রেক বানিয়ে আলাদা ফাইল রাখার ব্যবস্থা করায় পাঠকদের অনেক সুবিধা হয়। সাথে সাথে তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের মাসিক ফাইল বাধাই করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় পনের বছর পর সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোর এবং ডেইলি ষ্টারের ফাইল বাঁধাই শুরু করা হয়। বাঁধাই করে রাখা ফাইলগুলো এখন মুল্যবাণ রেফারেন্স।
(লেখক অনলাইন দৈনিক গ্রীনওয়াচ পত্রিকার সম্পাদক এবং ঢাকার ইংরেজী দৈনিক দ্যা এশিয়ান এজ-এর কন্সালট্যান্ট এডিটর (পরামর্শক সম্পাদক।)