বাজেট প্রতিক্রিয়া প্রজ্ঞা, আত্মা -করারোপে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী

তিন বছর ধরে দামি সিগারেটের দাম (দশ শলাকা ১০১ টাকা) অপরিবর্তিত রাখার মাধ্যমে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর মৃত্যুবিপণন ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ অব্যাহত থাকল এবারের বাজেটেও। অথচ গত তিনবছরে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে এই প্রস্তাব চরম জনস্বাস্থ্যবিরোধী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে জাতীয় মাথাপিছু আয় (নমিন্যাল) বেড়েছে ২৪.৬৪ শতাংশ। অথচ এই একই সময়ে এই স্তরের সিগারেটের দাম না বাড়ায় এর প্রকৃত মূল্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারও বাড়তি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইসাথে গ্রামীণ সমাজে বহুল ব্যবহৃত বিড়ির দাম প্রস্তাবিত বাজেটে অপরিবর্তিত রাখার ফলে নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যঝুকিঁও বেড়ে যাবে। সার্বিকভাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের কোনো দিকনির্দেশনা এবারের বাজেটে না থাকায় হতাশ তামাকবিরোধীরা।প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চস্তরে ১০১ টাকা মূল্যের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫% অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যা খুবই হতাশাজনক। এই মূল্যস্তরের সিগারেট বাজারে বহুল প্রচলিত এবং সিগারেট রাজস্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ আসে এই স্তর থেকে। এছাড়াও উচ্চস্তরে ৭০ টাকা মূল্যের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম মাত্র ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৭৫ টাকা নির্ধারণ এবং ৬৫% সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত রাখার মাধ্যমে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোকেই লাভবান হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মধ্যম স্তরে ৪৫ টাকা মূল্যের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে সম্পূরক শুল্ক ৬৩% এর স্থলে ৬৫% আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য (নিম্নস্তর) ২৭ টাকার স্থলে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এই স্তরে সম্পূরক শুল্ক মাত্র ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৫২% থেকে ৫৫% নির্ধারণ করা হয়েছে। জনগণের মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সিগারেটের এই মূল্যবৃদ্ধি অতি নগণ্য এবং এর ব্যবহার কমাতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবেনা। তামাকবিরোধীদের দীর্ঘদিনের দাবি একক কর কাঠামো ও সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রচলনের কোনো নির্দেশনা এবারের বাজেট ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়নি। এভাবে তামাক কোম্পানিগুলোকে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ দিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কখনই সম্ভব নয়।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইতিপূর্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিড়ির ব্যবহার বন্ধে একাধিকবার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা প্রহসন হিসেবেই দেখা দিয়েছে। বিড়ি কারখানার মালিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে প্রস্তাবিত বাজেটে বহুল প্রচলিত ফিল্টারবিহীন বিড়ির ২৫ শলাকার মূল্য ১২.৫ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। দেশীয় শিল্পের শ্রমিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিড়ি শিল্প বরাবরই সুবিধা পেয়েছে, যা প্রস্তাবিত বাজেটেও অব্যাহত থাকলো। এরফলে বিড়ির প্রধান ভোক্তা নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পাবে।
ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে করারোপের ক্ষেত্রে প্রচলিত এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বাতিলের জন্য তামাকবিরোধী আন্দোলনকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দা এবং গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫%। ওজনের উপর ভিত্তি করে জর্দা ও গুলের মূল্য নির্ধারণ করার ফলে এসব পণ্য থেকে কর আদায়ের জটিলতা কিছুটা হলেও সহজ হবে এবং আদায়কৃত করের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষতঃ নারীদের মাঝে এই পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জর্দা-গুল ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এই প্রয়াস নি:সন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রক্রিয়াজাত তামাকপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে এধরনের তামাকপণ্যের উপর আরোপিত ২৫% রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং চরম জনস্বাস্থ্যবিরোধী পদক্ষেপ। এরফলে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সুতরাং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকেই মূলত উৎসাহিত করা হবে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে।
অন্যান্য কর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে, সিগারেট-বিড়ি তৈরির পেপারের উপর নির্ধারিত আমদানি শুল্ক ২০% থেকে বৃদ্ধি করে ২৫% নির্ধারণ এবং সিগারেট, বিড়ি, জর্দা,গুলসহ সকল তামাক কোম্পানিগুলোর বিদ্যমান ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়াও সকল প্রকার তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী করদাতার ব্যবসায় থেকে অর্জিত আয়ের উপর বিদ্যমান ২.৫% সারচার্জ বহাল থাকবে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ২০৪১ সাল থেকে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নানা ভবিষ্যত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বললেও বাজেট প্রস্তাবনায় তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই। সিগারেটের মূল্যস্তর কমানোর কথা তিনি বলেছেন, অথচ উচ্চস্তরে দুইটি বিভাজনসহ সিগারেটে মোট চারটি স্তর বহাল রয়েছে। বিড়ির ব্যবহার হ্রাসেও কোনো পদক্ষেপ প্রস্তাবিত বাজেটে গ্রহণ করা হয়নি। সার্বিকভাবে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট তামাকবিরোধীদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।
ABM Zubair, Executive Director-