লেবাসের অসম্মান করা অনুচিত নয়কি?

মোস্তফা কামাল মজুমদার
ইংরেজীতে বলে ‘ফেস ইজ দ্য ইন্ডেক্স অব মাইন্ড’। তার মানে, চেহারা দেখে মন চেনা যায়। এটাতো একটা চিরন্তন বাকধারা। আমরা একে অন্যকে চেনা ও বোঝার জন্য যে কয়টা জিনিষ পরখ করি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেশভূষা – জীর্ণশীর্ণ, সাধারণ, স্মার্ট না আনস্মার্ট, চেহারা মলিন না হাস্যোজ্জ্বল; কোন কিছুর দিকে লক্ষ্য নির্দিষ্ট নাকি খোলা মন এবং যে কোন আকার-ইংগিতে সাড়া দেবে ইত্যাদি। কিন্তু এরকম যেকোন অবয়বের কারণে মানুষকে তুছ্য জ্ঞানকরা বা অসম্মান করা অনুচিত নয়কি?
শুনতে বেখাপ্পা ঠেকবে। নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র সহসভাপতি মওলানা আব্দুর রশিদ মজুমদার ২০১৪ সালে পল্টনে তাঁদের পার্টি অফিসে আয়োজিত এক ইফতার মহফিলে এই লেখককে স্মরণ করিয়ে দেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাক হানাদার সেনা-আগমনের ভুল ভিতিকর ঘোষণার ফলে আমরা মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং-এর মাঠ থেকে কিভাবে দৌড়ে নীচে নেমে নিজেদের আড়াল করি। আবার ভুল ভাঙ্গার পর ট্রেনিং-এর জন্য মাঠে ফিরে আসি। ৪৩ বছর পর একথা মনে করিয়ে দেয়ায় আমরা উভয়ে বেশ কিছুক্ষন হাসাহাসি করি। সশ্রুমন্ডিত আব্দুর রশিদ মজুমদার গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি পড়েন। আমার মনে ছিলনা যে চাঁদপুরের কচুয়া থানা শহরে অবস্থিত কচুয়া পাইলট হাই স্কুলমাঠে সময়ের প্রয়োজনে স্বেছাপ্রনোদিত আয়োজনে অংশনেয়া অল্প কয়েকদিনের মামুলি ট্রেনিং-এ আব্দুর রশিদ মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন।
হানাদার সেনা উপস্থিতির ভুল ঘোষণা দেন বন্দুকের গুলির একটা বিকট শব্দ কচুয়া বাজারের দিক থেকে আসার পর। কচুয়া আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রশিদ তখন উপস্থিত ট্রেইনিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। আওয়াজ শোনার পর তিনি বলে বসেন, ‘ভাইয়েরা হানাদার সেনারা কচুয়া বাজারে এসে গেছে। আপনারা যে যেদিকে পারেন পালান’। স্কুল মাঠটা কৃষিজমির চাইতে একটু উঁচু করে বাঁধানো যেন বর্ষার পানিতে ডুবে না যায়। ট্রেনিং-এ উপস্থিত কয়েকশত যুবক ঘোষণা শোনেই দৌড়ে গিয়ে মাঠের বিভিন্ন কিনারায় নীচে নেমে আত্ম্রক্ষার অবস্থান নেয়। কিছুক্ষন পর ভুল ভাংলো এবং সবাই উপরে ওঠে আসলো। ব্যাপারটা এতো বছর পর মনে করিয়ে দিলে স্মৃতির সাগরে নিমজ্জ্বত হবার সাথে সাথে কার মুখে হাসি না আসে। আব্দুর রশিদ মজুমদার এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর স্মৃতিতে একটু ফাড়াক ছিল। সেখানে উপস্থিত এমসিএ মুরহুম আব্দুল আউয়াল, কচুয়া ডিগ্রী কলেজ (বর্তমানে বংগবন্ধু ডিগ্রী কলেজ) -এর প্রিন্সিপাল স্কোয়াড্রন লীডার আব্দুল করিম এবং ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের তখনকার ছাত্র ও ইউওটিসি ক্যাডেট মোস্তফা কামাল মজুমদার দৌড়ে পালাননি, নিজ নিজ যায়গায় দন্ডায়মান ছিলেন। তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষা রাজনৈতিক অবস্থানও দৌহিক অবয়বের কারণে আজকে যদি কেউ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন তাহলে ক্ষতি কি আব্দুর রশীদ মজুমদারের একার হবে?
ইফতারের মহফিলে উল্লেখিত আলাপচারিতার পর ফেসবুকে একটা ষ্টেটাস দেই। কেউ কেউ সেষ্টেটাসে লাইক দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গ্রন্থাগারিক আব্দুল লতিফ মজুমদার সে স্টেটাসে এক আবেগ-আপ্লুত কমেন্ট দেন, সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য। আব্দুল লতিফ মজুমদারও সেই স্বেচ্চাপ্রনোদিত ট্রেনিং-এ অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে রেফেরেন্স ছিল কোথায় কোথায় সে ট্রেনিং নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। আমাদের দূর্ভাগ্য, গেল ডিসেম্বর মাসে তিনি পরলোক গমন করেছেন। শেষ বয়সে তার অবয়ব ছিল বাংলাদেশের মুরুব্বি শ্রেনীর মানুষের সনাতন সূরতের। সাদা লম্বা দাঁড়ি, মাথায় টুপি। তিনি কচুয়া কল্যান সমিতির সভাপতি ছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ সমিতির আয়োজিত বার্ষিক ইফতার মহফিলে উক্ত উপজেলার গুনীজনরা একত্রিত এক দশকের বেশী সময় ধরে। মৃত্যুর অল্পকিছুদিন আগে এক বেপরোয়া চালক তাঁর পায়ের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে দিয়ে মারাত্মক আহত করে। তাঁর নেতৃত্বধীন সমিতি কচুয়া এলাকার মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করে। চিন্তা ধ্যান ধারণায় প্রগতিশীল আব্দুল লতিফ মজুমদার ছিলেন আত্মসম্মানে বলীয়ান কচুয়া পাইলট হাই স্কুলের খ্যাতনামা শিক্ষক ওচমান মজুমদারের জেষ্ঠ পূত্র। তখন হেডমাষ্টার খলিলুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে এ স্কুল একটা আদর্শ বিদ্যাপীটে পরিণত হয়। হেডমাষ্টার খলিলুর রহমান সাহেব কচুয়া থানায় তাঁর নিজস্ব গ্রাম নিশ্চিন্তপুরে গড়ে তোলেন এক আদর্শ মাদ্রাসা। ওচমান মজুমদার এবং খলিলুর রহমান উভয়ে ছিলেন ধার্মিক, সশ্রুমন্ডিত।
অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার প্রধান ফটো সাংবাদিক নারায়ণগঞ্জের মরহুম জহিরুল হক বরাবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুসারি ছিলেন। শেষ জীবনে এসে তিনি বেশ লম্বা দাঁড়ি রাখতেন, প্রতি বছর হজ্জ্ব করতেন এবং সৌদী ধাঁচের আলখেল্লা পড়তেন। সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে তাঁর শাসইনামলে ফটো সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে সম্মান জানানোর পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদ-বিরোধী ছাত্র অন্দোলনের ছবি তুলতে গেলে কিছু ছাত্র তাঁকে রাজাকার বলে গালি দেন। জহিরুল হক রাগে ফেটে পড়েন। আলখেল্লার নিচু অংশ উপরে তুলে কোমড়ে বেঁধে তিনি অসীম সাহস নিয়ে গালমন্দ উচ্চারণকারি ছাত্রদের পিঁচু ধাওয়া করেণ। সহকর্মি ফটো সাংবাদিকরা তাঁকে ছাত্রদের উপর প্রতিশোধ নেয়া থেকে নিবৃত করে ফিরিয়ে নিয়ে আনেন।
ঢাকার এক ত্রিশোর্ধ গাড়ীর ড্রাইভার আলমগীর, গলব্লাডার অপারেশনের পর থেকে দাড়ি রাখছে এবং সর্বদা টুপি পরে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ড্রাইভার আলমগীরকে অনেকে রাস্তাঘাটে হুজুর বা মৌলভীসাব বলে সম্বোদন করেণ। অনেকেই তাকে আগে সালাম জানান। একদিন তার গাড়ী নিয়ে মিরপূর ১০ নম্বর চৌরাস্তার দক্ষিণে এক গলি থেকে বেগম রোকেয়া সরণীতে ওঠার সময় এক ট্রাফিক সার্জেন্ট তাৎক্ষনিক তাকে গাড়ীর কাগজপত্র দেখাতে বলেন। আলমগীর ব্যস্ত মেইনরোডে আড়করা অবস্থা থেকে গাড়ীটা সাইড করার অনুমতি চাইলে সার্জেন্ট সাহেব বলেন, তা লাগবেনা, কারণ কাজটা আধা মিনিটের ব্যাপার। অগত্যা সেই অবস্থায় সব বৈধ কাগজপত্র দেখার পর সার্জেন্ট সাহেব আলমগীরের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চান। তা হাতে পেয়ে সার্জেন্ট সাহেব একবার লাইসেন্সের দিকে, আরেকবার আলমগীরের মুখের দিকে তাকান। বলেন লাইসেন্সের ছবি তার কিনা। কারণ সেই ছবিতে দাঁড়ি নেই। আলমগীর আত্মবশ্বাসের সাথে বলল ওটা তারই ছবি। জবাবে সার্জেন্ট সাহেব বললেন, ‘সূরতের এই হাল কেন’? এই অসম্মান কি ড্রাইভার আলমগীরের প্রাপ্য ছিল?
অবশ্য এখনকার দিনে কিছু ক্রিমিনাল আলখেল্লা, দাঁড়ি টুপি পরিধান করে তাদের অপরাধের শিকার মানুষগুলোকে প্রতারিত করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ইমার্জেন্সি বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রাস্তার পাড়ে একটা ঔষধের দোকানে একসময় সকল কর্মি পাঞ্জাবী টুপি পরে বেচাকেনা করত। পরে আবিষ্কার হয়, ঐ দোকান থেকে নকল ট্যাবলেট, ক্যাপ্সুল বিক্রি হত। মালিক ছিলেন ডাক্তার নামের অপব্যবহারকারী এক ডাক্তার কুলাঙ্গার। এদের কথা ভিন্ন। কিন্তু অপরাধ নির্দিষ্ট হবার আগে কাউকে অপরাধী বলে দায়ী করা অন্যায়। আর স্বীয় বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা এবং বেশভূষার জন্য কাউকে গালমন্দ করা শুধু আরো বড় অন্যায় নয়, রীতিমত অপরাধ।
জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকার পাঞ্জাকানা নামাজের ইমাম একজন সহজ সরল মানুষ। একদিন কিছু মুক্তাদির সাথে তিনি কঠোরভাবে কিছু বাক্য বিনিময় করেন। কারণ এক মুক্তাদি প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা কোন আলেমের কথা শোনবেন। কারণ একই বিষয়ে একএক আলেম একএক ব্যাখ্যা দেন। ইমাম সাহেব একজনকে বলেছিলেন মোনাজাতের সময় দুইহাত বুকের সমান উঁচু করে ধরবেন। হাত বুকের নীচে পেটের কাছেও রাখবেননা, আবার মাথার ওপরেও ওঠাবেন না। এই উপদেশের প্রতিবাদ করায় ইমাম সাহেব বলেন। ‘আপনারা তাবলীগের চিল্লা থেকে ফেরত আসা আলখেল্লা পরা সাধারন মানুষ, হজ্জ্ব থেকে ফেরত আলখেল্লা পরিধানকারি হাজী এবং মুরুব্বি আলখেল্লাধারি সবাইকে আলেম মনে করেন এবং হুজুর বলেন। আরে ভাই সব হুজুর আলেম নয়, হুজুর নয়। যারা ধর্মিয় শিক্ষায় শিক্ষিত তারাই এ বিষয়ে উপদেশ দেবার যোগ্যতা রাখেন’।
উপরের আলোচনা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ধার্মিক বা ধর্মিয় পোষাক-আসাকধারি মানুষের বিরুদ্ধে টিপ্পনি কাটার বা তাচ্ছিল্ল করার সেই বৃটিশ ঔপনিবেশিক ধারা এখনো কাটেনি। কেউ কেউ সমাজে মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য বা প্রতিযোগিতায় তাদের পেছনে ফেলে রাখার অস্ত্র হিসেবে এধারা অব্যাহত রাখার প্রয়াস পাচ্ছেন। যৌবনের শেষে বা চাকুরী থেকে অবসরের পর যখন তারা সমাজের সনাতন ধারায় ফিরে যান তখন তা আর শোধরাবার সময় থাকেনা।