১১ নভেম্বর ২০১৭ আলহাজ্ব কে এম আব্দুল করিম এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

– ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
আজ থেকে ১ বছর আগে আমার আব্বা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম (রাহিমাহুল্লাহ) দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিলেন। তিনি ১১ নভেম্বর ২০১৬, শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি আর কখনও আমাদের মাঝে আসবেন না, চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ভাবতে অবাক লাগে- মৃত্যুর পর ইতোমধ্যে কেটে গেছে ১ টি বছর ।বাবাকে মনে পড়ে ভীষণভাবে। হে আল্লাহ! তোমার বান্দাহ কে তুমি ক্ষমা করে দিও, (রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।)
ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মানুষের মনে তার জন্য যে ভালোবাসা পয়দা করে দিয়েছো, সেই তাকে মাটির কবরে তোমার কুদরতি ভালোবাসায় সিক্ত করো । যে সম্মান দুনিয়ায় তুমি তাকে দান করেছো, শেষ বিচারের দিনে মেহেরবানী করে তার সম্মান আরো বাড়িয়ে দিও । নশ্বর এ পৃথিবীতে তুমি তাকে দয়াকরে যে সুখ, শান্তি, আরাম দিয়েছো, চীরস্থায়ী জান্নাতে মায়াকরে তাকে তা দান করো । জান্নাতে তোমার পাশে একটি ঘর দিও । আমিন।
এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের মধ্যেই আছেন। তুমি আজ বেচে আছ মানুষের ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে বেচে থাকবে আমাদের মাঝে আজীবন। কেমন আছেন আমাদের বাবা তা হয়তো আমরা দেখতে পাইনা , তবে অনুভব করি তিনি সব সময় আমাদের পাশেই আছেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপায় অনকে ভাল থেকে আমাদের অনুপ্ররেণা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদরে প্রিয় “বাবা”র জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আল্লাহ রব্বুল আল-আমীন যেন তাকে জান্নাত বাসী করেন।
বাবা আর ফিরবে না। আমিও চলে যাবো। ফিরব না। আজকে যারা বেঁচে আছি একদিন সবাই চলে যাবো, কেউ ফিরব না। তবে যত দিন আছি, এ ধরাধামে তত দিন তো বাবা হারানোর ব্যথা বয়ে বেড়াতে হবে।
তবুও সব ব্যথা, সব যন্ত্রণা ছাপিয়ে যদি বাবার মতো হতে পারতাম। বাবার মতো উদার মনের মানুষ। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। যদি তার স্বপ্নের সমান বড় হতে পারতাম।আব্বা নেই! তার অনুপুস্থিতি আমাদের মাঝে বিরাট শুন্যতা তৈরি করেছে। আল্লাহ যেন তার অসম্পূর্ণ কাজ গুলি আমাদের দ্বারা পূর্ণতা দান করেন।
আমার বাবা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম ( রাহিমাহুল্লাহ ) ছিলেন ঝালকাঠী জেলার রাজাপুরস্থ সাতুরিয়া হামিদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। আমার বই পড়ার অভ্যেস বাবাকে দেখেই। প্রচুর ইংরেজি শব্দ জানতেন, ছোটোবেলায় আমাদের শেখাতেন। তার শিক্ষকতার আদর্শই তার সমগ্র জীবনাচরণের অঙ্কুর ও শেকড়কে ধারণ করেছিল। এদিকে তার সকল মানবিক গুণাবলি, কর্তব্য-পরায়ণতা, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, সাহসিকতা ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর সমুদয় সত্যনিষ্ঠায় যর্থাথই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় I বাবা যা সঠিক মনে করেছেন, তা দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন। কখনো তিনি আশা ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করেছেন, আমাদের মধ্যে যে অপূর্ণতা, অসত্য ও অমানবিকতা রয়েছে, তা পেরিয়ে আমরা একদিন সত্যিই সুন্দর ও সত্যের ভোর দেখব।
আমার বাবা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম ( রাহিমাহুল্লাহ ) এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে সাতুরিয়া ইঞ্জিনিয়ার এ,কে,এম রেজাউল করিম কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, আমড়াঝুড়ি জামিয়া ইসলামীয়া বহুমুখী দাখিল মাদ্রাসা, কে,এম, আ: করিম জামিয়া ইসলামীয়া এতিমখানা অন্যতম।
এছাড়াও শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, মাওলানা আ: রহীম, (র:) স্মৃতি পাঠাগার, মোস্তফা হায়দার একাডেমী, পূর্ব আমড়াঝুড়ি বায়তুল মামুর জামে মসজিদ, সাতুরিয়া খানবাড়ী জামে মসজিদ, উত্তর তারাবুনিয়া মোল্লাবাড়ী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠির মানোন্নয়নে ভূমীকা রেখেছেন। সম্প্রতি কাউখালি শহরে দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারা ও বিশ্রামাগার স্থাপিত হয়েছে মোসলেম আলী খান ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায়। ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলায় তিনি বাংলা অনুবাদ কোরআন শরীফ বিতরন করেন।
সেবামূলক কাজ পরিচালনার জন্য মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে গরীব ছাত্র-ছাত্রী ও মসজিদের ইমামদের মধ্যে আর্থিক সহয়তা প্রদান করেছেন। রাজাপুর শহরে আর্সেনিক মুক্ত বিশুদ্ধ পানির জন্য তিনি সম্প্রতি ইসরাব নামক একটি এনজিওকে ঋন দিয়েছেন।
বাবা কতো লোকের উপকার করেছেন, কতো স্টুডেন্টকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন, পার্থিব সম্পদের চাইতে মনের ঐশ্বর্য বাড়াতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনোই বিন্দুমাত্রও অহংকার দেখাতে দেখিনি। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় আমার বাবা একজন আজন্ম সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। সভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। কখনোই তার মধ্যে কোন গোঁড়ামি দেখিনি।
ভয়াবহ ঘুর্নঝড় সিডরের পরে মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ত্রান তৎপরতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এ সময় তার প্রতিষ্ঠিত মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাউখালি, ভান্ডারিয়া, ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর, কাঠালিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালির কলাপড়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং বাকেরগঞ্জ থানায় ৩ হাজার ৬শ ৭০ জন দূর্গত মানুষের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি, শীতের কাপড়, শুকনো খাবার, হাড়ি-পাতিল,থালাবাসন, খাবার স্যালাইন, ঔষধ ও নগদ অর্থ বিতরন করেন। কুরবানীতে তিনি কাউখালি ও ভান্ডারিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে এবং রাজাপুর ও ঝালকাঠিতে পশু কোরবানী দিয়ে সিডর আক্রান্ত ২ হাজার দুস্থ মানুষের মধ্যে গোশত বিতরন করেছেন। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। যার মধ্যে কাউখালির কেউন্দা স্কুল ও সাতুরিয়া রহমIতয়া দাখিল মাদ্রাসা অন্যতম। এসব এলাকায় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু মসজিদেও তিনি আর্থিক সহয়তা প্রদান করেন।
আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার বাবা। আমার বাবা সারাজীবন মানুষের উপকার করেছেন। তিনি নিজেকে নিয়ে যতটুকু ভাবতেন তার চেয়ে বেশি ভাবতেন দেশ এবং সমাজকে নিয়ে। তার জীবনের আদর্শ ছিলো মানুষের উপকার করা। সাধারণভাবে চলাফেরা করা তার পছন্দ ছিলো। তিনি সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন, কারো কোনো ক্ষতি করেননি। “কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি কোরো না।” ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি।বাবা তাঁর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনসহ সব বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন। বাড়িতে কেউ এলে কখনোই তাঁকে কিছু না খাইয়ে বাবা বিদায় দিতেন না। আপ্যায়ন করতে তিনি ভালোবাসতেন।
ছোট বেলায় বাবা যেমন আদর করতেন, তেমনি শাসনও করতেন। অন্যায়কে পশ্রয় দিতেন না তিনি কখনও। সব সময় শিখিয়েছেন- চরিত্রবান হতে হবে, সৎপথে চলতে হবে। লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল আমরা যেন পড়ালেখা শেষ করে ‘মানুষের মত মানুষ’ হতে পারি। পড়ালেখা করেছি, ‘মানুষ’ হতে পারব কিনা জানিনা। শুধু বলতে পারি তার প্রত্যাশা পূরণে আমি আজও নিরন্তর সাধনায়।
বাবা আমাদের জন্য তার আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
বাবা সব সময় এত অকৃত্রিম, অনাড়ম্বর ও সহজভাবে থাকতেন যে তাঁর হৃদয়ের বিশালতা, গভীরতা ও প্রজ্ঞাসহ বহুকিছুই আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি।মানুষকে ভালোবাসলে, তাদের জন্য কাজ করলে ও জীবন উৎসর্গ করলে মানুষ ভালবাসায় তার প্রতিদান দেয়। হয়ত আব্বার অনেক ভুলত্রুটি ছিল, ভুলত্রুটি ছাড়া তো কোন মানুষ নেই। আব্বার জানাজায় অনেক মানুষ এসেছিলেন । সবাই আব্বার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করেছেন, একজন ভাল মানুষ হিসেবে তাঁর হয়ে মাফ চেয়েছেন।
বাবা আমাদের জন্য তার আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
প্রতিটি সন্তানের কাছে এক শ্বাশত, মহান ও গভীর অনুভূতিপূর্ণ শব্দ হলো বাবা। সন্তান, কিংবা পরিবার, সবার কাছেই বাবা আশ্রয়ের নাম, নির্ভরতার প্রতীক। বাবার অবদান, ত্যাগ, স্নেহ, ভালোবাসা সকল তুলনার ঊর্ধে। পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কখনো শ্রদ্ধার, কখনো ভয়ের আবার কখনো বা বন্ধুত্বের। পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই তার মা-বাবাই শ্রেষ্ঠ। আমার কাছেও তাই। পৃথিবীতে অন্য আট-দশ জন বাবা থেকে আমার বাবা একটু আলাদা। কারণ বাবার চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা সবকিছু ভিন্ন রকম। পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষকে দেখেছি নিজের স্বার্থের জন্য মানুষের উপকার করে। কিন্তু সবসময় আমার বাবাকে দেখতাম নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করতে। প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি করে হলেও মানুষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করত। তার সঞ্চয় ছিল শুধু মানুষের ভালোবাসা। আজন্ম লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বেব থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। বাবার মৃত্যুর পর অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাসায় তাঁরা এসেছেন। দেশের নানা প্রান্ত ও দেশের বাইরে থেকে ফোন করেছেন। বাবার প্রতি তাঁদের যে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি দেখেছি, তা অতুলনীয় ও হৃদয়স্পর্শী। ভালোবাসার সম্ভবত একটি তরঙ্গ আছে। বাবা যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তারাও তেমনি ভালোবাসতেন বাবাকে। ভালোবাসার সেই অদৃশ্য তরঙ্গ সবাইকে স্পর্শ করত।
আমার বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সকলের কাছে বিনয়ের সাথে দোয়া চাই। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের মধ্যেই আছেন। তুমি আজ বেচে আছ মানুষের ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে বেচে থাকবে আমাদের মাঝে আজীবন। কেমন আছেন আমাদের বাবা তা হয়তো আমরা দেখতে পাইনা , তবে অনুভব করি তিনি সব সময় আমাদের পাশেই আছেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপায় অনকে ভাল থেকে আমাদের অনুপ্ররেণা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদরে প্রিয় “বাবা”র জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আল্লাহ রব্বুল আল-আমীন যেন তাকে জান্নাত বাসী করেন।
বাবা আজ তুমি নেই , আজ তুমি ছাড়া আমরা যে কি অসহায় তা বুঝতে ভুল হয়না একটি বার। তুমি ছিলে আমাদের প্রান আর আমরা ও ছিলাম তোমার প্রান। আল্লাহ আমার বাবার সকল পাপ মাফ করো, কবরের আযাব মাফ করো, তার রূহের শান্তি দাও, তাকে জান্নাত দাও ।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছগীরা ।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছগীরা ।
‘‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’’
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের কবুল করুন। আমিন।
(লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিষ্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ ।)