আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন হুমায়ুন কবির খোকন

বিপুল হাসান
সময়টা ছিল বিগত শতকের শেষ বছর। বাংলামোটর জোহরা ম্যানশনের পর শাহবাগের পথে বহুতল ভবন ছিল একটাই, ওয়েলসো টাওয়ার। নিচতালায় ছিল দেশের প্রথম ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনের অফিস। দারুণ কাটতি ছিল তখন পত্রিকাটার। হুমায়ুন কবির খোকনের সঙ্গে পরিচয় সেখানেই।মাস্টার্স পরীক্ষার পর রেজাল্টের অপেক্ষায় আমি। লেখালেখির অভ্যাসটা আগেই ছিল। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে অংশ নেওয়া সূত্রে পরিচয় ছিল দুই কবি আলফ্রেড খোকন আর মুজিব ইরমের সঙ্গে। দুজনই কাজ করতেন মানবজমিন পত্রিকায়। একজন বের করতেন প্রতিদিন ‘টিনেজ’ পাতা, অন্যজন ‘কোলাজ’ নামে একটি পাতা। দুজনই তাদের পাতায় লিখতে বলতেন। পত্রিকায় লিখলে পয়সা পাওয়া যাবে, বাসা থেকে বিড়ি খাওয়ার টাকাটা চুরি-চামারি করে যোগাড় করতে হবে না, এটা ভেবেই মানবজমিনে কন্ট্রিবিউট শুরু করি। দু-চার দিন পর পর পত্রিকা অফিসে আসা যাওয়া করি। ওই সময় হালকা গড়ন পাতলা গোঁফের হুমায়ুন কবির খোকনকে দেখতাম খুব চটপটে , সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলে। টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল মানবজমিনের ক্যান্টিন। একদিন চা খেতে গিয়ে একা পেয়ে গেলাম তাকে।
পরিচয়ের শুরুতে সবসময়ের মতো হুমায়ুন কবির খোকনের মুখটা হাসি হাসিই ছিল। হাসি মুখেই জানালো, তিন মাস হলো জয়েন করেছেন। গাইড নামের একটা পাতার দায়িত্বে আছেন। জানতে চাইলেন, আমি কোন ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। বললাম, জয়েন তো করেনি। একটু যেন থমকে গেলেন তিনি, ‘মানে.. আপনি আমাদের স্টাফ না?’
উইলস কিং ব্রান্ডের সিগারেটটাতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, ‘নাহ। কন্ট্রিবিউট করি।’
একবার তিনি দেখলেন আমার চেহারাকে, আরেকবার তাকালেন আধপোড়া সিগারেটটার দিকে। মুহূর্তে হুমায়ুন কবির খোকনের মুখ থেকে হাসি উধাও। গম্ভীর হয়ে গেলেন, কাপের অর্ধেক চা না খেয়েই হন হন করে সিড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি তো আক্কেল গুড়ুম, পত্রিকা অফিসে এ আবার কোন কালচার! এরপর মাঝে মধ্যে হুমায়ুন কবির খোকনের সঙ্গে দেখা হলেও তিনি মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতেন।
কন্ট্রিবিউট শুরুর ১৫ দিন পর এক দুপুরে ওয়েলসো টাওয়ারে গেলাম। তখন তো আর মোবাইল-টোবাইল ছিল না যে, কল দিয়ে যাবো বা খোঁজ নিয়ে যাবো। মানবজমিন অফিসে গেলাম, বিভাগীয় সম্পাদক আলফ্রেড খোকনের ডেস্কের সামনে বসে বক্স থেকে কি কি লেখা গেছে আর কি কি যায়নি মিলিয়ে দেখছি। পাশেই ছিল মফস্বল ডেস্ক, মফস্বল সম্পাদক শামীম ভাইয়ের ডেস্কে ছিল ফোন। উনিই জানালেন, আলফ্রেড খোকন ফোন করেছিলেন। তার মারাত্মক জন্ডিস, বাসা থেকে বের হওয়া বারণ। তাহলে… আমি আর বসে থেকে কি করবো! ওঠবো ভাবছি।
ঠিক এমন সময় আধাপাকা চুলের একলোক করিডোর ধরে হন হন করে এসেই চিৎকার শুরু করে দিলেন, ‘আলফ্রেড খোকন অসুস্থ এইটা আগে কেন জানাইলা না? এখন পেইজ কে করবে? নাকি পেইজ সাদা ছাড়বো?
সবাই দেখলাম একদম গুটিয়ে গেলো, কেউ কোনো কথা বলে না।
আমি অবশ্য উনাকে চিনি। উনার নাম আহমেদ ফারুক হাসান। মানবজমিনের বার্তা সম্পাদক। সাংঘাতিক মেধাবী, কিন্তু মারাত্মক কড়া লোক। কারও কোনো ভুল নাকি উনি সহ্য করেন না। রিপোর্টে কোনো ভুল থাকলে রিপোর্টারকে ডেকে এনে কাগজটা মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, গরুর রচনা তোরে লিখতে কে বলছে? এমন বদমেজাজি মানুষকে ভয় না পেয়ে উপায় আছে!
হঠাৎ আমার দিকে আহমেদ ফারুক হাসানের চোখ পড়লো, ‘এই আপনি কে? এইখানে কি করেন?’
আমি চুপ, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ডেস্কে রাখা বক্সগুলো আলফ্রেড খোকনে অবর্তমানে ধরাটাই কি আমার অপরাধ! আমতা আমতা করে বললাম, আমি টিনেজ পাতায় কন্ট্রিবিউট করি।
‘আচ্ছা, খোকনের কন্ট্রিবিউটর? হাতে পেইজ করার মতো ম্যাটার আছে? পেইজ করতে পারবেন?’
নিজের লেখাসহ কম্পোজ করা অনেকগুলো অপ্রকাশিত লেখা ছিল, তাই কিছু না বুঝেই বললাম, ‘জি, পেইজ করার মতো ম্যাটার আছে।
আহমেদ ফারুক হাসান বললেন, ‘যান পেজ মেকআপে গিয়ে বসেন। আধাঘণ্টার মধ্যে শেষ করবেন।’
জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো পত্রিকা অফিসের কম্পিউটার সেকশনে ঢুকলাম। সারি সারি অ্যাপেল পিসি, তখন পত্রিকার কাজ হতো অ্যাপলের ম্যাকিনটোশ মেশিন। আমি শতভাগ আনাড়ি, মেকআপ কাকে বলে কিছুই বুঝি না। দেখলাম একটু দূরে আরেক পাশে হুমায়ুন কবির খোকন তার গাইড পাতা নিয়ে বসেছেন, সাদাকালো পাতা। তিনি মুখে বলছেন, সেই অনুযায়ী অপারেটর বা ডিজাইনার কাজ করছেন। আমাকে দেখে একটু বোধহয় চমকে ওঠলেন। কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
ইন্টারকমে বোধহয় বার্তা সম্পাদক ফারুক ভাই আমার কথা ডিটিপি ইনচার্জকে বলে দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘আপনিই তো আজকে টিনেজ পেইজ করবেন। দাঁড়ায়া আছেন কেন? যান স্বপন ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে বসেন।’
টিনেজ পেইজটা ছিল ফোর কালার। কালার পেইজের ডিজাইনদের হাবভাবই তখন ছিল অন্যরকম। মেকআপ যিনি করতেন; তিনি একধরনের ধমক দিয়েই বললেন, ‘কি কি ম্যাটার যাবে দেন?’
প্রুফ রিডার দেখার পর ফাইনাল প্রিন্ট করা কাগজগুলো তার সামনে দিলাম। প্রতিটি লেখার উপর ফাইলের নাম লেখা। খুব দ্রুত উনি লেখাগুলো পিসির ফরম্যাট করা স্ক্রিনে এনে জানতে চাইলেন, ‘লিড যাবে কোনটা? ছবি যাবে কি? ছবি স্ক্যান করাইছেন? পেইজ মেকাপে বসার আগে ছবি স্ক্যান করিয়ে নিবেন। দেন ছবি দেন।’
স্ক্যান কাকে বলে তাই তো জানি না। আগে থেকে করাবো কি! বক্সে কয়েকটা টিনেজাররের ছবি ছিল, ছবিগুলো বের করে দিলাম? ফটোকপির মতো মেশিনে সেগুলো স্ক্যান হলো।
এবার ডিজাইনার জানতে চাইলেন, লিড নিউজ ডিসি নাকি থ্রিসি? বোকার মতো বললাম, ডিসি কি আর থ্রিসি কি!
ডিটিপি রুমে হাসির একটা ঢেউ খেলে গেলো। কাউকে বোধহয় বলতে শোনলাম, আবালরে এইহানে ঢুকতে দিলো কে?
আমি বোধহয় ওইসময় ঘাবড়ে গিয়ে কেঁদেই ফেলতাম, যদি কাঁধে সাহস জাগানিয়া হাতের একটা স্পর্শ না পেতাম। হুমায়ুন কবির খোকন আমার কাঁধে হাত রেখে কোমল গলায় বলেছিলেন, ‘ডিসি মানে ডাবল কলাম, থ্রিসি মানে তিন কলাম।’
কন্ট্রিবিউটার হিসেবে কাজ শুরুর ১৭ দিন পর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ( মতি ভাই) আমাকে ডেকে নিয়োগ পত্র তুলে দিলেন। বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা। তিনমাসের মধ্যে দেখা গেল নাট্যাঙ্গন, বিতর্ক এবং দাম্পত্য তিনটি পাতা আমার সম্পাদনায় বের হচ্ছে। আড়াই বছরের মতো ছিলাম দৈনিক মানবজমিনে। খুব কাছাকাছিই ছিল আমার আর হুমায়ুন কবির খোকনের ডেস্ক। তাকে আমি ‘গাইড ভাই’ বলে ডাকতাম।
অনেকে মনে করতেন ‘গাইড’ নামে পাতা বের করেন বলে আামি তাকে গাইড ভাই ডাকি। আসলে তো তা না। ওই যে কম্পিউটার রুমে আমাকে তো উনিই গাইড করেছিলেন।
পরে তার কাছে জানতে চেয়েছি, পরিচয়ের শুরুতে ক্যান্টিনে ওরকম পল্টি নিয়েছিলেন কেন? জবাবে বলেছিলেন, যেভাবে বিড়ি টানছিলেন.. ফটকা পোলাপান ভেবেছিলাম। হুমায়ুন কবির খোকন ছিলেন নন স্মোকার, তার ফুসফস তো শক্তিশালি থাকার কথা। কিন্তু আণুবীক্ষণিক দানব করোনা কী করে তাতে কামড় বসালো?
ক্যারিয়ারের সূচনালগ্নে হুমায়ুন কবির খোকনের সঙ্গে ওই মানবজমিনেই কেবল কাজ করি। অল্পদিনেই কাছের মানুষ হয়ে ওঠেছিলেন।
জীবনের নিয়মে এরপর ছুটে চলা, আমি এক স্টেশন আর উনি আরেক স্টেশন। শেষ দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে একুশে বইমেলায়। তখন হুমায়ুন কবির খোকন বোধহয় ছিলেন আমাদের অর্থনীতির বার্তা সম্পাদক। নতুন মিশন দৈনিক সময়ের আলোতে তিনি জয়েন করেছেন তাও কানে এসেছে। ফেসবুকে টুকটাক লাইক আর বার্তা বিনিময়ও হয়েছে, কিন্তু দেখা হয়নি।
এই জীবনে হুমায়ুন কবির খোকনের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম