আসাদ চৌধুরী আমাদের সবার কবি

মোস্তফা কামাল মজুমদার
কবি আসাদ চৌধুরীকে দেখলে একজন সাধারণ সরল প্রকৃতির মাটির মানুষ মনে হয়। বিশাল তার ব্যক্তিত্ব কিন্তু সহজেই তার সাথে মেশা যায়। কথাবার্তায়, বেশভূষায় এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে তিনি দেশজ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ষাটের দশকে তার কবিসত্বা পাঠককুলের নজরে আসে। সে থেকে তিনি লিখেই চলেছেন। ঢাকার বাংলা কাব্যসাহিত্য সত্তরের দশকে কোলকাতার কাব্যসাহিত্যকে ছাড়িয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে ঢাকার এই নেতৃত্ব এখন কথাসাহিত্যেও বিরাজমান। যাদের অবদানে ঢাকা এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে তদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী অন্যতম।বরিশালের উলানিয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান প্রতিভাধর আসাদ চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের মাষ্টার, চৌধুরী প্রথম জীবনে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে কলেজে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে কাজ করেন। সে সময় তিনি জয় বাংলা পত্রিকারও সহকারী সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি দৈনিক জনপদের সাংবাদিক ছিলেন। স্বাধীনতার পুর্বে তিনি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাথে তিনবছর সংবাদদাতা ছিলেন। কর্মজীবনের বেশীরভাগ সময় (২৬ বছর) তিনি কাটিয়েছেন বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে। জার্মানির ডয়েস ওয়েল-এর বাংলা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন তিনি আশির দশকের শেষের দিকে। বেতার ও টেলিভিষণে তিনি একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে বহুদিন কাজ করেছেন। এই বহুমাত্রিক কাজের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন তাঁর কবিতা। তার সাথে রচনা করেছেন ছড়া-কবিতা, অনুবাদ, জীবনীগ্রন্থ এবং রূপকথার গল্প। করেছেন কবিতা আবৃত্তি।
৭৫ বছর বয়েসেও আগের মতই কর্মঠ, প্রানচঞ্চল এবং হাস্যোজ্বল, আসাদ চৌধুরী সবার কবি। কোন গন্ডিতে তিনি বাঁধা নন। দলমত নির্বিশেষে তিনি সবার কাছে আপন। বিভেদের যে সর্বনাশা চিন্তার নৈরাজ্য দিনে দিনে আমাদের দেশে চিন্তার সার্বজনীনতাকে বিপদ্গ্রস্ত করে তুলেছে, তার আচড় কবি আসাদ চৌধুরীর গায়ে লেগেছে বলে মনে হয়না। তিনি সজাগ আছেন, চিন্তা-চেতনার স্বাধীনতা, সৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত না থাকলে এমনকি দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। তাই সব যুগসন্ধিক্ষণে তাকে দেখা গেছে কবিতায় মানুষের মনের কথাকে সাবলিলভাবে নিয়ে আসতে। কারণ আসাদ চৌধুরীর মত কবি হবার জন্য সামাজিক পরিবেশের যে অবদান ছিল, তার কমতি হোক তা কি তিনি মেনে নিতে পারেন?
সাহিত্যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের যে মনন তৈরীর প্রয়োজন ছিল তার একটা আদর্শ সামাজিক পরিবেশ এদেশে দানা বাঁধতে শুরু করে ষাটের দশকের আগে থেকে। জমিদারী প্রথা ১৯৫০ সালে উচ্ছেদ করার পর এদেশের সমাজে ভূ-সম্পদ নিয়ে মানূষের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ওঠে যায়। তখনকার দিনে ভূ-সম্পদই ছিল সামাজিক প্রতিপত্তির নিয়ামক। সরকারী বেসরকারী চাকুরি বা ব্যবসায় বা শিল্প কারখানা-সৃষ্ট সামাজিক সামাজিক বৈষম্য তখনো এদেশে বিকাশ লাভ করেনি। এখন বিদেশে চাকুরি করে উপার্জনের যে বিশাল ভূমিকা সমাজ ও অর্থনীতিতে আছে তা তখন চিন্তাও করা যেতনা। এই পদক্ষেপের কারনে মানুষের মধ্যে সামাজিক সাম্য পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। তার দুবছর পর এদেশের ভাষা অন্দোলন সফল হয়। এর ফলে সৃষ্ট স্বাধিকারের আন্দোলন, তার প্রেক্ষাপটে পরবর্তিতে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। প্রদেশের রাজধানী থেকে ঢাকা পরিনতি লাভ করে একটা স্বাধীন জাতির রাজধানী হিসেবে। এসব বিশাল সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের সৃজনশীল প্রভাব এদেশের মানুষের মননকে দারুনভাবে প্রভাবিত করে। সৃষ্টিহয় শক্তিশালী গল্প কবিতা। কবি আসাদ চৌধুরী এই ধারারই ধারক ও বাহক।
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে তাঁর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এপর্যন্ত প্রায় শ’খানেক গ্রন্থের এক বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলেছে। এখনকার দিনে অনেকে অন্যের লেখা গোপনে কপি করে নিয়ে নিজের নামে বই প্রকাশ করে খ্যাতি অর্জনের প্রয়াশ পান। এমনকি পুরো বই শুধু লেখকের নামাংশ পরিবর্তন করে ছাপাবারও নজির রয়েছে। আসাদ চৌধুরী মৌলিক কবি, নিজের সৃষ্টিতে মহিয়ান। বাংলার মানুষের দেশজ ও মরমি চিন্তা চেতনার প্রতিনিধি আসাদ চৌধুরীর জন্য আগ্রণী ব্যাংক, পুরষ্কার, বাংলা একাডেমী পুরষ্কার বা একুশে পদক তার কাজের স্বীকৃতি মাত্র। চিন্তা, চেতনা ও সৃষ্টিতে তিনি আরো বড়। আমরা তাঁর সৃষ্টিশীল দীর্ঘায়ু কামনা করি।
(সিনিয়র সাংবাদিক, মোস্তফা কামাল মজুমদার, গ্রীনওয়াচ ঢাকা পত্রিকার সম্পাদক।) ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ইং