এক রাজার রমণী হওয়ার কাহিনী

প্রাচীন কালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ বছর। সে সময়ের এক রাজার কাহিনী। রাজার সবই ছিল, হাতি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত, মনমুগ্ধকর রাজপ্রাসাদ, বিশালতম রাজ্যের সীমানা। তার উপরে ছিল ১০০জন পুত্র সন্তান। পুত্র গর্বে গর্বিত পিতার মাটিতে পা পরে না। দেবতাদের মান্য করে না। কথায় কথায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেবতাদের, অপমান করে। পূজোতো দেয়ই না।প্রমাদ গুনলো দেবতারা। এভাবে চলতে থাকলে, মত্তের মানুষ একসময় কেউ আর দেবতাদের মান্য করবে না। পূজা-অর্চণা সব বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে ভোগ, দান, প্রসাদ বিতরণ; না খেয়ে মরতে হবে দেবতাদের! অতএব জরুরী সভা। পৌরহিত্য করছেন, স্বয়ং মহাদেব। একটা বিহিত তো করতে হবে। মর্তের মানুষের এত বড় স্পর্ধা! দেবতাদের গালি গালাজ করে! একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে এই অর্বাচীন দাম্ভিক রাজাকে। বিস্তৃত আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, হ্যাঁ, কঠিন শিক্ষাই দিতে হবে। এছাড়া কোন উপায় নেই। ভাল মন্দ সব বিবেচনা করে রাজাকে শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। কিন্তু কৌশলগত কারণে কি সিদ্ধান্ত তা গোপন রাখা হল।
এর কতকদিন পর, রাজা প্রাতঃভ্রমন শেষে প্রাসাদের সরোবরে, জলকেলি করতে নামলেন, নেমেই দিলেন একটা ডুব। ব্যাস রাজা আর উঠে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, রাজা উঠছেনই না, দেবতাদের অভিশাপ ফলতে শুরু করেছে। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, রাজা উঠছেনই না। সরোবরে চারিদিকে, পাত্র-মিত্র অনুগতদের ভীড় বাড়তে থাকে। সবার উৎকণ্ঠাও বাড়তে থাকে। আরো কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ জল থেকে উঠে আসে, এক সুঠাম দেহী অপরূপ সুন্দরী রমণী। সবাই অবাক! রাজা রানী হয়ে গেছেন! রাজা স্ফীত হেসে বললেন, কোন ব্যাপার না। এতদিন পুরুষ ছিলাম। এখন নারী। রাজা বিয়ে করে বসলেন, এক তাগড়া জোয়ান সেনা সদস্যকে।
কেটে গেল অনেক বছর। নারীরূপী রাজা তার উদর থেকে জন্ম দিলেন, আরো একশজন পুত্র সন্তান। আগে ছিল একশজন। এখন হয়ে গেল দু’শজন। একশজনের সে পিতা, আর একশজনের সে মাতা। এখন আরো বেপড়োয়া। দেবতাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গালি গালাজ করে। রাজা ফরমান জারি করেন, কেউ যেন দেবতাদের পূজা না করে। করলে তার গর্দান যাবে। দেবতারা একেবারে পর্যাদুস্ত। পূজা পায় না। ভোগ পায় না। প্রসাদ পায় না। তার উপর অপমান আছেই। মর্তের ভোগ-প্রসাদ এসব না পেলে যে, না খেয়ে মরতে হবে। অতএব আবার জরুরী সভা।
সভার শুরুতে যথারীতি, মেনকা অপ্সরাদের নৃত্যগীত পরিবেশিত হলেও সবই ছিল প্রাণহীন। আমোদে গা ভাষাতে পারছেন না, খোদ মহাদেবও। থামিয়ে দিলেন নৃত্য গীত।
মেনকা ঢলে পড়ল মহাদেবের গায়ে। না, মহাদেবের সেদিকেও ভ্রূক্ষেপ নেই। বললেন, সভার কাজ শুরু করা হোক।
এক এক করে দেবতারা তাদের দুঃখের করুণ কাহিনী বর্ণনা করলেন, কেউই পূজা পাচ্ছে না। সবাইকেই রীতিমত অপমান করা হচ্ছে। রাগে অগ্নিসর্মা মহাদেব। চিৎকার করে বললেন, “যাদের সে মা, ওরা এক পক্ষ। আর যাদের ও পিতা, তারা আরেক পক্ষ। এই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দাও। যাতে করে, দুশজনই মারা যায়। মনে রেখো, যেন দুশজনই মারা যায়। একজনকেও আমি জীবিত দেখতে চাই না”। মহর্ষী নারদ কোথায়?
নারদ তঠস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আজ্ঞে মহাদেব, আপনি আদেশ করুন। মহাদেব বললেন, এদের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব তোমাকে দিলাম। যত তারাতারি সম্ভব কার্য সম্পাদন করো। এই নাও বিশেষ শক্তি কবজ। যাও এখনই বেড়িয়ে পড়ো।
অঘটনঘটনপটীয়সী নারদের সুতীক্ষ্ণ চালাকির ফলে লেগে গেল যুদ্ধ, ভয়াবহ যুদ্ধ, সামনা সামনি, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে। কেউ পারে না যুদ্ধ থামাতে। একদিন, দুদিন, অবশেষে তিনদিন অবিরাম যুদ্ধের পর যুদ্ধ থামল। কিন্তু ততক্ষণে দুশজনই প্রাণ হারালো।
এবার ভেঙে পড়লেন নারীরূপী রাজা। ভূলুন্ঠিত হয়ে দেবতাদের প্রনতি জানিয়ে ক্ষমা চাইলেন। ক্ষমা করো প্রভু, ইত্যাদি, ইত্যাদি। মহাদেবের আজ্ঞা পেয়ে নারদ বলল, পূজার ব্যবস্থা করো। রাজকীয় পূজা। পূজার সব ব্যবস্থা করা হল। সাত সমূদ্রের জল আনা হলো, সোনার বেল পাতা আনা হল। গণিকার আঙিনার মাটি আনা হলো, আরো কত কি! রাজা বললেন, ক্ষমা করো হে দেবতাগণ। দেবতা বললেন, কি বর চাস? রাজা বললেন, পূত্রদের ফিরিয়ে দাও প্রভূ। দেবতা বললেন, সবাইকে পাবে না, হয় তুমি, যাদের মা তাদের, নয়তো যাদের পিতা তাদের। বলো, কোন গুলোকে ফেরত চাও। এই আদেশের নরচর হবে না। রাজা কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করে বলল, ওদের ফেরত চাই, যাদের আমি আমার জঠর থেকে জন্ম দিয়েছি, আমি যে তাদের মা। তাদের জন্য মনটা কাঁদে। মহাদেব বললেন, তথাস্তু।
রাজা বললেন, দয়া করে আমায়, নারীই রেখে দিন। কারণ পুরুষ হিসাবে শতাদিক বৎসর কাটিয়েছি; নারী হিসাবেও শতাদিক বছর কাটিয়েছি। উভয় জীবন ধারণ করে, আমি বুঝেছি, নারীতেই সুখ বেশী।
(মোতাহার হোসেন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ)