কবি ফররুখ আহমদের জন্ম শতবার্ষিকী

– ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম
আজ আমাদের চল্লিশ দশকের জননন্দিত কবি ফররুখ আহমদ শতবর্ষে এসে পৌঁছেছেন। মহাকবি ফররুখ আহমদ এর জন্ম শতবার্ষিকীতে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
কবি ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা “রাত্রি” ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় (শ্রাবণ-১৩৪৪ সংখ্যায়) প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই কবি আজীবন ছিলেন সৃজনশীল। ঐ বছরই কবির একগুচ্ছ কবিতা বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। বলতে গেলে ১৯৪৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশ হওয়ার পর সমালোচকরা তাকে স্বীকার করে নিলেন একজন প্রতিভাবান কবি হিসেবে। এ যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন- সেই সঙ্গে হৃদয়েও গেঁথে গেলেন। এই সালেই অকাল প্রয়াত প্রতিভাবান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত “আকাল” সংকলনে ফররুখ আহমদের বিখ্যাত “লাশ” কবিতাটিকে স্থান দেন।। সেই কারণে আমরা স্বভাবত দেখতে পাচ্ছি ফররুখ আহমদের কবি জীবন দু’টি ভাগে বিভক্ত। কোলকাতা জীবনে তার কবিতা ডান-বাম উভয় গোষ্ঠীর পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকাতেই পাড়ি জমালেন। এখানেই কাটালেন বাকি জীবন। অনেকে মনে করেন কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন কেবল মাত্র একজন কবি। তথ্য হিসেবে এটি মোটেও ঠিক নয়। তিনি ছিলেন গীতিকার, (যার বহু গান ফেরদৌসি রহমান-সহ অনেক ভালো ভালো গায়ক গেয়েছেন) কাব্য নাটক, গদ্য নাটক-রচিয়তা (যার নাটকে মুনীর চৌধুরীর মত নাট্যকার অভিনয় করেছেন)। তিনি একমাত্র কবি সমকালীন পাকিস্তানী সরকার প্রদত্ত “সিতারা-ই ইমতিয়াজ (১৯৬৬)” খেতাব প্রত্যাখ্যান করে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। সত্যি বলতে কি এই রকম চরমতম আদর্শবাদী কবি- আমাদের সাহিত্যে আর একটিও নেই, ভবিষ্যতে পাবো কিনা বলতে পারিনা।
তবে এখন নেই-এটা হলপ করে বলতে পারা যায়। এহেন শক্তিমান কবিকেও চাকরির ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। যারা পাকিস্তান আমলে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারাই হয়ে গেলেন তীব্র বিরোধী। কবির কি অপরাধ ছিলো এখনো আমরা জানতে পারিনি। তবে একটা অপরাধ ছিলো অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের সাথে তিনি যৌবনের শুরুতেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। তবুও একসময় চাকরি থেকেও বরখাস্ত হয়েছেন। তবে এসব অন্যায়ের চরমতম উত্তর দিয়েছিলেন জাগ্রত বিবেকের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তীব্র তীক্ষন প্রতিবেদনে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘গণকণ্ঠ’ ১ লা আষাঢ় ১৩৮০ সংখ্যায়। এই প্রতিবেদনে কাজ হলেও কবি ফিরে পেলেন না তার আনন্দের আসল জায়গা। তবে এরপর কবি আর বেশি দিন ধরাধামে ছিলেন না। পাড়ি দিলেন তাঁর বিশ্বাসের শেষ ডেরাতে -১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ঠিক সন্ধ্যে বেলায়।
আমার ব্যক্তিগত পর্যালোচনায় দেখেছি তিনি জীবিতকালীন যেমন ছিলেন অসামান্য সৃজনশীল, আলোচিত হওয়ার পর পাশাপাশি সমালোচিত মৃত্যুর পর শুরু হলো আবার আলোচনার পালা, বিশেষত আবদুল মান্নান সৈয়দের অসামান্য সম্পাদনায় ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বের হওয়ার পর।
তবে এটা ঠিক যে ফররুখ আহমদের জামানার সাহিত্যিক পরিবেশ এখন আর নেই। বলতে গেলে এখন সাহিত্যিকদের মধ্যে চলছে অহেতুক সাহিত্য বিবর্জিত অসুয়া জনিত বিদ্বেষের প্রতিযোগিতা। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি পায় দলীয় আদর্শের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে। বিষয়টা এই রকম তাকে স্মরণ করার কাজ যেন মুষ্ঠিমেয় ঐতিহ্যবাদীদের। তবুও ফররুখের সৌভাগ্য যে, ইসলামপন্থী কবি সাহিত্যিকদের লেখা পাঠ্য তালিকা থেকে তাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে; তাতে ফররুখ আহমদ বেঁচে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ফররুখ আহমদকে তাড়ানো যাচ্ছেনা। বলা বাহুল্য এখানেই ফররুখ আহমদের কবিতার অসামান্যতা এবং আমাদের কবিতার গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছেন যাকে উৎপাটন করা অসাধ্য মনে হচ্ছে। হয়তো এই কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাকে যথার্থ আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অপরাজেয়’ বলে। যদিও এই মতামত প্রয়াত হুমায়ূন আজাদের মোটেও পছন্দ হয়নি।
কবিকে মূল্যায়ন করার অন্যতম হাতিয়ার হলো তার রচনাকর্ম সহজলভ্য হওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ফররুখ আহমদের বেলায় সেটি হচ্ছেনা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলি এখন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রকাশিত হওয়ার কারণে নজরুল চর্চার পরিধি আগের তুলনায় বাড়ছে। যাই হোক, এবার আমাদের আলোচনার আসল প্রসংগে আসা যাক। বাংলা একাডেমির কাছে ফররুখ শতবর্ষ পালন উপলক্ষে যে প্রত্যাশা আমাদের থেকে যাচ্ছে সেটাই জানানো দরকার। বাংলা কবিতার পাঠক মাত্রই জানেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মহতি আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি আজকের বাংলা একাডেমিকে। যদিও তখন সেই নাম ছিলো কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন-বোর্ড। কবি ফররুখ আহমদ চিরকালই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থক ছিলেন। আমরা প্রয়াত এই মহৎ কবির কাছে থেকে যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ পেয়েছি তার একটি বাংলা ভাষা বিষয়ে, যার শিরোনামই হলো “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য”। তিনি সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন- “আমি আগেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সাংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।”
আর এই ভাবে ফররুখ আহমদ হয়ে যান ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির একজন সৈনিক। এটা হয়তো অনেকেই জানেনা যে, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিকের শাহাদাতের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার বাহিরে প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনি তুলেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বেতারের শিল্পীরা; তাদের অন্যতম ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। এই মহতি প্রতিষ্ঠানের সাথে ফররুখ আহমদের আজীবন সুসম্পর্ক ছিলো। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমির উদযাপিত নাট্য সপ্তাহে “নৌফেল ও হাতেম” নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিলো, তিনি এই সালেই প্রতিষ্ঠানের ফেলো নির্বাচিত হন। কিন্তু সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল ঐ বছরেই। কবিতাই প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনায়। অনেকের ধারণা ছিলো কবি জসীমউদ্দীন এই পুরস্কার পাচ্ছেন, কারণ তখন তিনি প্রবীণ কবিদের অন্যতম। তিনি পুরস্কার না পাওয়াতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ার উত্তরে বাংলা একাডেমি কতৃপক্ষ বলেছিলো তিনিতো পুরষ্কারের উর্ধ্বে। তবে এটা জসীমউদ্দীনকে আহত করেছিলো। এই কারণে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুমতি দেননি। পরবর্তীকালে অনেক বই তাঁর বড় ছেলের প্রতিষ্ঠিত ‘পলাশ প্রকাশনী’ থেকে বের হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদের অন্যতম সৃষ্টি ‘হাতেম তাই’ প্রকাশ করেছিলো বাংলা একাডেমি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে বাংলা একাডেমির জন্মলগ্ন থেকেই ফররুখ আহমদ জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই স্বভাবতই ফররুখ আহমদের জন্ম শতবার্ষিকীতে এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে আমাদের কিছু বিশেষ প্রত্যাশা থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কোন তৎপরতা এ যাবৎ আমরা লক্ষ্য করিনি। এর আগে বাংলা একাডেমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে চমৎকার দু’টি সংখ্যা বের করেছিলো। এ দুজনেই বাংলা সাহিত্যের অমর ব্যক্তি নিঃসন্দেহে; পাশাপাশি ফররুখ আহমদও তার যোগ্যতা বলে সেই রকমই দাবীদার হয়ে যান। ফররুখ আহমদের সৃজনশীলতার উপর অনেক ভালো ভালো সমালোচক তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সেগুলো এক করা দরকার। ফররুখ আহমদের বেশ কিছু কবিতা ‘কবিতা’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিলো সে গুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে করে ভবিষ্যতে যারা কবির উপর গবেষণা করতে আগ্রহী হবেন, তাদের পক্ষে ভালো সুযোগ সৃষ্টি হবে। উন্নততর দেশগুলোতে এই রকম সংরক্ষণাগার অহরহ চোখে পড়ে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই রকম কিছু পদক্ষেপ এ যাবৎ শুধু বাংলা একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়া- অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেয়নি। যারা নিয়েছেন তাঁদেরও নিরপেক্ষতার অভাব রয়েছে। বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় এর আগে ফররুখের কাব্যগ্রন্থ, অনুবাদ, কবিতা ও প্রবন্ধ সমন্বয়ে একটি রচনাবলি বের হয়েছিলো। যার সম্পাদনায় ছিলেন ফররুখ অনুরাগী দুই কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ও প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ। এই গ্রন্থ প্রকাশের অনেক পরে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সুদক্ষ সম্পাদনায় দুই খন্ড রচনাবলি বের করে বাংলা একাডেমি। যথাক্রমে আগস্ট ১৪০২/ জুন ১৯৯৫ ও আগস্ট ১৪০৩/জুন ১৯৯৬ সালে। বাংলা একাডেমির এই মহৎ কাজে আমরা ফররুখ অনুরাগীরা স্বভাবতই বাংলা একাডেমির কাছে ঋণী থাকতে বাধ্য। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে- পরবর্তী খন্ডগুলো প্রকাশের মুখ আর দেখেনি। ইতোমধ্যে রচনাবলির সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মত অনুসন্ধানী সম্পাদককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির ঘাড়ে পড়েছে। বাংলা একাডেমি সেই মহৎ কাজে এগিয়ে যাবেন আশা করা যায়। অন্যান্য প্রকাশকরা যখন কবির ভাষায় :- বিকায়ে নিজের সত্ত্বা যে ভোলে জাতীয় তমুদ্দন হবে না কি তার দলে ধার করা কদলী-বেগুন।
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র প্রতিষ্ঠিতা ।