গাজী শমসের ও দৈয়া বিবির কাহিনী

মোতাহার হোসেন
ফেনী-শুভপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের একটি জায়গার নাম পাঠান নগর। এ পাঠান নগরের কন্ডাগদার (কনট্রাক্টর) মসজিদের পাশ দিয়ে নেমে গেছে দাইয়া বি’র রাস্তা, এ রাস্তা দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটারের মত পথ পাড়ি দিলে পাবেন দাইয়া বি’র হাট। এই দাইয়া বি’র হাটের ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে দুইশত বছর আগের বাংলার ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাসে। বাংলার ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা, যখন বাংলার স্বাধীনতা ও নবাব সিরাজের ভাগ্য অস্তাচলগামী ঠিক সে সময় এ এলাকার আরেক জমিদারের ভাগ্য নিয়তির নির্মম পরিহাসে বিপর্যস্ত। তিনি জমিদার নাসির মোহাম্মদ। পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, মিরসরাই এবং এতদসংলগ্ন এলাকা নিয়ে গঠিত চাকলালা রৌশন আবাদের জমিদার নাসির মোহাম্মদ। তিনিও জমিদারি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন এই সময়কালে। নাসির মোহাম্মদের একমাত্র কন্যা দৈয়া বিবি। অপরূপ সুন্দরী দৈয়া রুপে লক্ষ্মী, গুনে সরস্বতী। ঠিক যেন দেবী প্রতিমা। প্রেমে পড়েছিলেন জমিদারের সামান্য তহশিলদার শমসের গাজী। শমসেরের ছিল বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী। গোপনে এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ভুগরভস্থ প্রশিক্ষণসালায়। যা বর্তমানে শমসের গাজীর এক্ষুল্লাহ নামে পরিচিত। জমিদার তার একমাত্র কন্যাকে সামান্য কর্মচারীর কাছে বিয়ে দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে এবং রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। শমসেরও ছাড়ার পাত্র নয়। প্রস্তুতি তো তার আগেই ছিল। অতএব বেধে যায় যুদ্ধ। যুদ্ধে নাসির মোহাম্মদ শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। শমসের পেয়ে যায় জমিদারী এবং জমিদার কন্যা।
এ প্রসংগে এ এলাকায় একটি প্রবাদ চালু আছে গ্রামের লোক কাউকে ধমক দিতে বা দাবড়িয়ে দিতে চাইলে এখনো বলে “এক্কেরে দোম্বাই উদোপুর নিমোগোই” (একেবারে দৌড়িয়ে উদয়পুর নিয়ে যাব)। শমসের গাজীর কাছে পরাজিত হয়ে নাসির মোহাম্মদ উদয়পুর এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে থেকে এই প্রবাদের প্রচলন।
আমরা দাইয়া বি’র হাটের কথা বলছিলাম। গ্রামের মাঝখানে একটি হাট। সপ্তাহে দুইদিন বৃহস্পতি ও রবিবারে বসতো, এখনো বসে। তবে জনসংখ্যা বাড়ায় এবং উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায় স্থায়ী দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিনই জনসমাগম হয়, বিকিকিনি হয়। বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল এখন দাইয়া বি’র হাট। তবু কোথায় যেন বিষাদ লুকিয়ে আছে, কান্না লুকিয়ে আছে। কাঁদছে দৈয়া বিবি, শমসেরমাতা পুণ্যবতী। গভীর রাতে বাতাসের হুহু ধ্বনিতে আজও কান্নার শব্দ শুনতে পায়। বাতাসের ধ্বনিতে শুনতে পায় বিলাপের সুর। কিসের বিষাদ, কেন এই কান্না! সুখ বেশিদিন সয়নি যে দৈয়া বিবির, পুণ্যবতীর, শমসেরের।
দুধর্স যুদ্ধ করে বীর শমসের জমিদারী এবং জমিদার কন্যা লাভ করে। প্রাণাধিক ভালোবাসতো স্ত্রী দৈয়া কে, মা কে, এবং প্রজা সাধারণকে। প্রজা সাধারণের কল্যাণে স্ত্রীর নামে রাস্তা নির্মাণ, বাজার বসানো, মায়ের নামে দিঘী খনন, মগ এবং জলদস্যুদের হাত থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করে এ বীর যোদ্ধা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কিন্তু বিধি বাম। বাধ সাধলো খোদ ইংরেজ। এ সময় বাংলার নাম মাত্র নবাব মীরজাফরের বংশধরেরা হলেও শাসনভার ছিল ইংরেজদের হাতে। তারা ভাবল, স্বাধীনচেতা শমসের যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে এবং সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করছে একসময় সে বৃটিশদের জন্য ভয়ানক হয়ে উঠবে। অতএব অঙ্কুরেই শেষ করে দিতে হবে।
ইংরেজদের চাপের মুখে মুর্শিদাবাদের নবাবের ফৌজ ঘেরাও করে ফেলে শমসেরের আস্তানা। ধ্বংস করে দেয় ভুগর্ভস্থ অস্ত্রাগার। বন্দি করে শমসেরকে। মুর্সিদাবাদে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড মানুষ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ মানুষ এখনও ভোলেনি শমসেরকে। তারা তাঁকে গাজী বলে সম্মানের সাথে সম্বোধন করে। বাতাসের ক্রন্দন শুন, বিরহ গীতি গায়, চোখের জল ফেলে।
(মোতাহার হোসেন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক, বি আই ডাব্লিও টি এ)