জুনাব আলীর ব্যব্হৃত গ্রামীন দেশজ প্রযুক্তি

মোস্তফা কামাল মজুমদার
অনেক দিন আগের কথা। আমাদের হালের একটা বলদ খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। ঘরেরই একজনের মত আপন জুনাব আলী জানালেন, বলদটার পিছনের একপায়ের হাঁটু মস্কে গেছে। পাড়ার সবার কথা বলদটাকে জবাই করে মাংস খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজে লাগবে না। জুনাব আলী তা মানতে নারাজ। বললেন তার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। কাজে লাগতে পারে। গ্রামের বাড়িতে তখন আমাদের চারটা বলদ ও একটা গাভী ছিল। চারটা বলদ দুই হাল টানতো। গাভীটাকে হালের কাজে ব্যবহার করা হতনা। কারণ তাহলে তার দেয়া দুধের পরিমান কমে যাবে। জুনাব আলী আমাদের পাশের বাড়ীরই মানুষ। তারা চার ভাই। জুনাব আলী তাদের মধ্যে কাজে ছিলেন চৌকোস। সাধারন হাল চাষের পাশাপাশি তিনি ভাল বাঁশ-বেতের কাজ জানতেন। তাছাড়া মাছ ধরা, মাছ ধরার জাল বোনা, চাই-আড়ি বানানো, গরুর মুখোস (কাউর), দড়ি বাঁধার … তৈরী প্রায় গ্রামীন সব কাজে পারদর্শি।
একদিন জুনাব আলী, আমাদের ছোট চাচা ফক্রুল ইসলাম মজুমদার, আমার বড় ভাই মতিউল ইসলাম মজুমদার এবং আমাকে নিয়ে আমাদের ন্যাংড়া বলদটার একটা হিল্লে করার কাজে লেগে গেলেন। তিনি আমাদের সাথে নিয়ে বলদটাকে মাটিতে শোয়ালেন। সামনের এবং পেছনের দু’পা আলাদা করে রশি দিয়ে বাঁধলেন। একটা শক্ত বাঁশ দুই জোড়া পায়ের মাঝখান দিয়ে ঢুকিয়ে বললেন, আসেন আমরা বাঁশের এক প্রান্তে দু’জন করে কাঁধে নিয়ে বলদটাকে ঝুলিয়ে রাখি। যেই কথা সেই কাজ। আমার বড় ভাই অতিশয় সহজ সরল একজন বডি-বিল্ডার ছিলেন। তিনি একাই একদিক কাঁধে নেয়ার প্রস্তাব করলে জুনাব আলী তা নাকচ করে দেন। বলেন ভাই, ব্যাথা পাবেন। তার কথায় বাঁশের প্রত্যেক প্রান্তে দু’জন করে কাঁধ মিলিয়ে বলদটাকে মিনিট দুয়েক ঝুলিয়ে রাখলাম।
দু’পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখার সময় বলদটা ভয় পেয়েছিল। কিন্তু এক পায়ের ব্যাথায় কাতর, তার করার কিছু ছিলনা। তাছাড়া বিশ্বস্ত জুনাব আলীর হাতে তার পা বাঁধা হয়েছে সেকারনে হয়তোবা তার ভেতরে কিছুটা নির্ভয়ও কাজ করেছে। কাজেই আমাদের কাজটা নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন করি। ঝুলন্ত অবস্থা থেকে মাটিতে শুইয়ে পায়ের বাঁধগুলো খুলে দিলে বলদটা সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। একপা, দুপা করে কয়েকবার খুঁড়িয়ে হাঁটল। আস্তে আস্তে খোঁড়ানো কমতে লাগল। পরের দিন সকালে উঠে দেখি বলদটা স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে। জুনাব আলী তাকে কয়েকদিন বিশ্রামে রেখে আবার হালের কাজে লাগিয়ে দিলেন। আমাদের পরিবার অসময়ে আরেকটা বলদ কেনার আর্থিক চাপ থেকে রেহাই পেল।
তীক্ষন বুদ্দিসম্পন্ন জুনাব আলী মনের দিক থেকে ছিলেন সরল প্রকৃতির। নিজে কোরান শরীফ পড়া জানতেননা বলে তার স্ত্রীর কাছে মর্যাদায় খাটো ছিলেন। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটির কারনে বেশ কয়েক বছর তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়েছিল। তার শশুর তখন বলতেন, শিক্ষিত মেয়েটাকে অশিক্ষিতের কাছে বিয়ে দিয়ে এই ঝামেলা হয়েছে। জুনাব আলীর শশুড়ের কথায় যুক্তি সরকারীভাবে গ্রাহ্য ছিল। কারন জানা যায় ১৯৬১ সালের আদম শুমারীতে অক্ষরজ্ঞ্যান সম্পন্নদের মধ্যে কোরান শরীফ যারা তেলাওয়াত করতে পারতেন তারা অন্তুর্ভূক্ত ছিল। এসব নিয়ে রাতে ঘুমোবার আগে জুনাব আলী প্রায়ই কান্নাকাটি করতেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে ছাড়া ছাড়ির সময়টাতেও তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী রাতে নিশিথে অন্যের বাড়ী বেড়াতে যাক তা কিছুতেই পছন্দ করতেন না।
জুনাব আলীর স্ত্রী লাইলি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এক সুন্দরী পল্লীবালা। কাটা কাটা নাক, চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ, মাথা ভরা কাল চুল, মাঝারি গড়ন। এক সন্ধ্যায় জুনাব আলী লাইলির অন্যবাড়ী বেড়াতে যাবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য আমার সাহায্য চাইলেন। সম্পন্ন ঘরের এক গৃহবধুর সাথে লাইলি তার ছোট মেয়ে নয়নিকে নিয়ে অন্যপাড়ার এক বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে।
ঠিক হল, জুনাব আলী ভূত সাজবেন সেই জোস্নাভরা রাতে। লাইলিকে ভয় দেখিয়ে বাপের নাম ভুলয়ে দেবেন। আমার দাদীর ধবধবে সাদা একটা শাড়ী তকে দিলাম। তিনি দুই হাতে একটা ছোট পাতিল উঁচু করে ধরে বললেন, ভাই শাড়িটা আমার গায়ে পেঁচিয়ে দেন। শাড়ী পেঁচানোর পর মনে হল জুনাব আলী বিশাল এক ভুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সাজে আমরা লাইলিদের ফেরার পথের পাশে একটা গাছের আড়ালে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ওদের ফেরত আসার কোন শব্দ পেলামনা। জুনাব আলীর পরামর্শে শাড়ীটা খুলে দিলাম। দু’জনে লাইলিদের ফেরার অপেক্ষায় পুকুর পাড়ে চুপ করা বসে থাকলাম। কিছুক্ষন পর জুনাব আলী তার ছোট মেয়ে নয়নির গলার আওয়াজ পেয়েই বলে উঠলেন, বললেন ভাই ওরা আসছে, শাড়ীটা আবার পেঁচিয়ে দেন। ভুত সেজে জুনাব আলী লাইলিদের পথরোধ করতে এগিয়ে গেল। প্রথমে সে নয়নির নজরে আসল। নয়নি ভয়ে ভয়ে তার মা লাইলিকে বলল, মা ঐটা কি? লাইলি বলল, কইলা। মুহূর্তের মধ্যে তিনজন মাগো মাগো বলে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে বাড়ী উঠল। দৌড়ের সময় ওরা তিনজন পায়ের স্যান্ডেল ফেলে পালাল। লাইলি এবং তার সাথের গৃহবধু দু’জনের শাড়ী কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেল। কিন্তু পাছে অন্যেরা জেনে যায় তাই ব্যাপারটা কাউকে জানালনা। আমি মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম এবং জুনাব আলীকে বললাম ভাই কাজটা ঠিক হলনা। জুনাল আলী বলেলেন, ঠিকই করেছি। এখন থেকে রাতে পাড়া বেড়ানি থামবে। আমরা দুজন আমার দাদীর সাদা শাড়ীটা গুছিয়ে ভাঁজ করে নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।
আমাদের অগ্রজদের অনেকের কথা-বার্তা চাল-চলন, আচার ব্যবহার নিয়ে জুনাব আলী অবসর সময়ে গল্প করতেন। তার নিজের কাজের বাহাদুরী নিয়েও বড়াই করতেন। আমরা তাকে ভাই বলে ডাকতাম। সিনিয়র হিসেবে আমাদের ঘরে তার অন্যরকম কদর ছিল। তার পরামর্শে কৃষিকাজের অনেক সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হত। হালের কোন বলদটার দাঁত শেষ, আর কর্মক্ষ্ম থাকবেনা জুনাব আলী বলে দিতেন।
তার মতে আমাদের বড়বাপ (দাদার চাচা) আলী আমজাদ মজুমদারের গুনের শেষ ছিলনা। তিনি বৃটিশ আমলে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন টানা ২৫ বছর। কুমিল্লা জেলা জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। আমাদের থানা সদর কচুয়া থেকে কাশিমপুর পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটা তার উদ্যোগ এবং তদারকিতে নির্মিত হয়। রাস্তা বানাতে গিয়ে তখনকার দিনেও তাকে টেটা-আক্রমনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমার স্মরণে যা আছে তা হল আলী আমজাদ মজুমদারে বৃদ্ধ বয়সের কিছু খন্ড চিত্র। সাদা লুঙ্গি পরিহিত এই বৃদ্ধ মানুষটি হেটে চলার ফাঁকে ফাঁকে ‘আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহ’ বলতেন। শেষ বয়েসে তিনি পায়ে হেঁটে হজ্বব্রত পালন করেছিলেন। জুনাব আলী জানান, তাঁর সাথে পায়ে হেঁটে কচুয়ে থেকে কুমিল্লা যারা গেছেন তারা জানান, জেলার ইংরেজ জজ আলী আমজাদ মজুমদারকে অনেক সম্মানের সাথে দেখতেন, এবং তাঁর সাথে সেভাবে ব্যবহার করতেন। শেষ বয়সে আলী আমজাদ মজুমদারকে ডাকলেও গ্রামের কোন সালিশি মিটিং-এ যেতেননা। জুনাব আলীর ভাষ্য, আলী আমজাদ মজুমদার বলতেন, ‘এখনকার মিটিং সিটিং আমি বুঝিনা।‘
মুক্তিযুদ্ধের বছরখানেক পর জুনাব আলী ভাঙ্গামন নিয়ে একদিন বললেন, থানার এক দারোগার তরফ থেকে খবর পাঠানো হয়েছে দেখা করতে। তাদের মেঝ ভাই আকরাম আলী অন্য চার ভাইয়ের বিরূদ্ধে জমির দখল নিয়ে মামলা করেছে। জুনাব আলীর আবদার আমি যেন তার সাথে যাই। তার বিশ্বাস তাতে তার ভাল হবে। দারোগা সাহেব নির্দিষ্ট দিনে আমাদের গ্রামের পূর্ব প্রান্তের সখিপুরা বাড়ীতে এসেছেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের কারনে সেসন এক বছর পিছিয়ে গেছে। সে যাক আমি তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে সখিপুরা গেলাম। সেখানে দারোগা সাহেবের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, ওটা ছিল ফৌজদারী মামলা। তাঁর তদন্তের উপর নির্ভর করছে আসামীরা গ্রেফতার হবে কিনা। জুনাব আলীর কথা ফলবান হল। দারোগা সাহেব একজন ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের ছাত্রের সাথে সম্মানের সাথে কথা বললেন। আমি তাঁকে বোঝালাম এই নিরীহ মানুষগুলো কি মামলায় উল্লেখিত অপরাধ করতে পারে? অবশ্যই না। রফা হল। দারোগা সাহেব সেই মতে রিপোর্ট দিতে রাজী হলেন। আকরাম আলীতো কেস দায়ের করে থানা থেকে গ্রেফতারী পরোয়ানার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তার আশায় গুড়েবালি। পরবর্তী তারিখে মামলা খারিজ হয়ে যায়। জুনাব আলী খুশীর সাথে আমাকে জানান কিভাবে আকরাম আলীর উকিল তার দিকে ফাইল ছুড়ে ফেলেছেন, থানায় খবর না রাখার জন্য। আকরাম আলীর সাথেও আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। কিছু অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন আকরাম আলী কিছুদিন আমার সামনে মুখ গোমরা করে থাকতেন। পরে তা ঠিক হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য ছিল, যে কারণেই হোক তার বেয়াদব ভাইদের শিক্ষা দেয়া। জুনাব আলীর বুদ্ধিমত্তার কাছে তিনি হার মানলেন।
মনে আছে, একবার জুনাব আলী ও তার ছোট ভাই হাসেম আলী আমাদের দুই নৌকা বেয়ে আমার চাচা তাজুল ইসলাম মজুমদারের শশুড় বাড়ী হাজীগঞ্জ বাজারের দক্ষিন পূর্বে অবস্থিত সোনার চর চৌধুরী বাড়ী নিয়ে যান। সাথে আরেকটা নৌকা বেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পার্শবর্তি গ্রামের ছুরুতির বাপ। তার নাম এখন আমার মনে পড়ছেনা। তার নৌকা অন্য দু’জনের নৌকা থেকে বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে তিনি আবিষ্কার করেন তার নৌকার ফাটল দিয়ে পানি চুয়িয়ে উঠে টৈট্মবুর এবং ভারী হয়ে গেছে তাই গতি বাড়াতে তার কষ্ট হচ্ছিল। পানি সেচে তিনি তার নৌকার গতি ফিরে পান। আমাদের যুক্ত পরিবারের প্রায় ১৫ জন সেই ভ্রমনের সঙ্গি ছিলাম। সাথে ছিলেন আমার বড় ফুফু আইয়ুবুন্নেছার ভাশুড় আলী হোসেন ভূঞা। কম বয়সে পছন্দের মেয়ে বিয়ে করতে না পেরে জীবনে তিনি আর বিয়ে করেননি। এক নৌকার গলুইয়ে শুয়ে তিনি গানে তান দেন, ‘যাওরে মাঝি ভাটি গাংগ বাইয়া, বাজানেরে কইও মাঝি নাইউর নিতে আইয়া’। নৌকায় ভ্রমনের পর গ্রাম দেশের সেই মেহমানদারি। আমাদের রীতি অনুসারে নৌকার চালকরা আমাদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করেন। খাবার পরিবেশনের সময় হাসেম আলী তার বড় ভাই জুনাব আলীকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওনার শশুড় বাড়ী নাই, এইটু খেয়াল কইরেন।‘ আমরা সবাই হেসে ফেলি। কেউ একজন বলে ওঠেন, হাসেম আলীকেও আরেকটু মুরগীর মাংস দিয়েন।
শেষ বয়সে এসে লাইলীর সাথে জুনাব আলীর ঝগড়া বিবাদের অবসান হয়। সারা পাড়ায় একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ইতি টানেন তারা। পারিবারিক শান্তির জন্য জুনাব আলী তাদের বাড়ীর উত্তরাংশে একটা বিচ্ছিন্ন প্লটে ঘর বাঁধেন। মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এই সময় তাদের ঘর আলো করে আরো দুই সন্তানের জন্ম হয়। আগের দুই ছেলে এক কন্যার সাথে নতুন দুই ছেলে নিয়ে পাঁচ সন্তানের গর্বিত জনক জননী হিসেবে তাদের শেষ জীবন ছিল অপেক্ষকৃত বেশী শান্তিময়। নিজের কৃষি কাজের যোগ্যতা নিয়ে গর্বিত জুনাব আলীর মত মানূষের দক্ষতার জন্যই অনেকাংশে কৃষিতে বাংলাদেশের আজকের এই সাফল্য। জুনাব আলী এখন নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে। তিনি নিরক্ষর ছিলেন সত্য, কিন্তু অশিক্ষিত ছিলেন কি?
(লেখক গ্রীনওয়াচ ঢাকা অনলাইন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক)