পিনাক লঞ্চ দূর্ঘটনার চতুর্থ বছর: বিচার হয় নি কারো

মোতাহার হোসেন
আজ ৪ঠা আগস্ট। আজ থেকে চার বছর আগে, ২০১৪ সালের এই দিনে, এম.এল. পিনাক ৬ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ মাওয়া ঘাটের অদূরে, পদ্মা নদীতে নিমজ্জিত হয়।
হতভাগ্য এই লঞ্চটি অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কাওরাকান্দি ঘাট থেকে মাওয়া ঘাট আসছিল, কিন্তু মাওয়া পৌঁছানুর আগেই দূর্বল কাঠামোর এই মোটর লঞ্চ (এম.এল.) প্রবল স্রোতে নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। শতশত যাত্রীর সলিল সমাধি হয়। আজ এই বিয়োগান্ত ঘটনার চতুর্থ বছর পূর্তি। দূর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি আজো নিশ্চিত করা হয় নি।আজ শনিবার ৪ঠা আগস্ট পিনাক ৬ ট্রাজেডির চতুর্থ বছর পূর্তি উপলক্ষে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে, রাজধানীর পুরানা পল্টনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যহ মানুষ মরছে, সড়কপথে এবং কিছুদিন অন্তর অন্তর মানুষ মরছে রেলে আর নৌপথে। কোন প্রতিকার হচ্ছে না। দোষীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্যও কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। দূর্ঘটনা ঘটলে কিছু দিন প্রতিবাদ হয়, পত্র পত্রিকায় এবং ফেসবুকে লেখালেখি হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়। দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা তো দূরের কথা, তাদের কেশও কেউ স্পর্ষ করতে পারে না। তাহলে কি আমরা এভাবেই সড়কে, রেলে কিংবা নৌপথে মরব! বেওয়ারিশ লাশ হব! কিংবা সলিল সমাধি হবে, লাশই পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, কথা হচ্ছিল পিনাক ৬ নিয়ে। লঞ্চটি ডুবল তো ডুবলই। এই লঞ্চে লাশ তো দূরের কথা, লঞ্চেরই আর হদিস পাওয়া যায় নি। পদ্মার অতলান্তে হারিয়ে গেছে চিরতরে।
লঞ্চটি ডুবার সময়। পাশে দিয়ে চলা অন্য একটি ফেরি থেকে একজন যাত্রী মোবাইলে ভিডিও করছিল। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকমিনিটের মধ্যেই লঞ্চটি নদী গর্ভে হারিয়ে যায়। পরে ডুবুরিরা অনেক অনুসন্ধান করেও এর খোঁজ পায় নি। জনৈক এক যাত্রীর মোবাইলে ধারণকৃত দৃশ্যই শেষ চিহ্ন হিসাবে রয়ে গেল। দিনটি ছিল ঈদের দুই দিন পরের ঘটনা। কেন এমনটি হল? দায় কার? এতগুলো মানুষের জীবনের কি কোন মূল্য নেই?
দেখভালের কি কেউ ছিল না? ছিল, অতিমাত্রায়ই ছিল। কিন্তু কোন কাজ করে নি। বিআইডব্লিউটিএ এর উদ্ধারকারী জাহাজসমূহ স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিল। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে সেবার হেলিকপ্টারও নাকি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। প্রতিবারের মত নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছিল। নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে; বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের কাজ হল, ঈদের আগের এবং পরের দিনগুলিতে বিভিন্ন নৌবন্দর ও গার্ড পয়েন্ট, যেসব পয়েন্ট থেকে, যাত্রী ওঠানামা করে, সেসব পয়েন্টে তদারকি করা।
যাতে করে কোন ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যাত্রী উঠাতে না পারে, বিপজ্জনক ভাবে অতিরিক্ত যাত্রী উঠাতে না পারে, অদক্ষ চালক দিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করতে না পারে এসব দেখভাল করা। সেবারও, মানে ২০১৪ সালে ঈদ উপলক্ষে মন্ত্রনালয় থেকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল ও স্থানীয় টাস্কফোর্স গঠনেরও নির্দেশ ছিল এবং দ্বায়িত্বও সুনির্দিষ্টভাবে দেওয়া ছিল।
তাহলে, এই লক্কর ঝক্কর মার্কা পিনাক ৬ বিপজ্জনক ভাবে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে, কি করে কাওরাকান্দি ছেড়ে আসল? সে সময়ে পত্রিকায় দেখা যায়, আসলে টাস্কফোর্স ছিল নামেমাত্র। সেইদিন কাওরাকান্দিতে টাস্কফোর্সের উপস্থিতি ছিলই না। বিআইডব্লিউটিএ এর একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ছিল, তাও চরযানাযাদ ঘাটে। একজন ইন্সপেক্টরের পক্ষে একই সময়ে দুই জায়গায় থাকা সম্ভব না। টাস্ক ফোর্সের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত থাকলে, ভাগ করে দুজায়গায়ই দেখভাল করা যেত। টাস্কফোর্স, স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে, অতিরিক্ত যাত্রীনিয়ে পিনাক ঘাট ছাড়তেই পারত না। এতে দূর্ঘটনা পরিহার করা যেত। তাহলে কি স্থানীয় ভাবে টাস্কফোর্স ছিল না? গঠনই করা হয় নি? গঠন করা হলে, তারা দ্বায়িত্ব পালন করল না কেন? আর গঠন করা না হলে, কেন গঠন করা হয় নি? এর জন্য দায়ীকে? এর কি কোন প্রতিকার হবে না? বিচার হবে না? যারা দ্বায়িত্ব অবহেলা করছে তাদের এবং ভবিষ্যতের জন্য আমরা কি কোন শিক্ষা নিব না? মন্ত্রনালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে টাস্কফোর্স গঠন করবে, বিভিন্ন নির্দেশনা দিবে, তা কার্যকর হবে না, এটা দুঃখ
জনক। এটা চলতে দেয়া যায় না। সব সময় আমরা দেখি, দূর্ঘটনার পর নিয়মমাফিক তদন্ত কমিটি বা তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়ে থাকে। সে কমিটি রিপোর্ট দেয়, সেই রিপোর্ট সচরাচর আলোর মুখ দেখে না, অথবা দেখলেও কমিটির সুপাারিশ কোন দিন বাস্তবায়ন করা হয় না। এই অবস্থা কতদিন চলবে? দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে অদ্যাবদি আমরা শতশত তদন্ত কমিটি দেখেছি। জনগনের করের টাকা ব্যয় করে, অনেক কর্মঘন্টা নষ্ট করে এসব তদন্ত কমিটি, প্রতিবেদনও দিয়ে থাকে। তবে এসবের বেশীরভাগ প্রতিবেদনই প্রকাশ হয় না। অথবা প্রকাশ হলেও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না।
আপাতদৃষ্টিতে সত্য উদ্ঘাটন এবং দায়ীদের সাজা নিশ্চিত করার জন্য কমিটির প্রয়োজন মনে হলেও আসলে কমিটি গঠন করা হয় ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। তাৎক্ষনিক ভাবে জনরোষ থামানোর জন্য। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ক্ষোভ এবং আবেগ যখন কমে যায়, তখন বিষয়টি বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। পুরো রিপোর্টটি বাক্স বন্দি হয়ে পরে। এটা উল্টিয়ে দেখারও কারো সময় হয় না। সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরাশা মাত্র।
তাই আমাদের প্রত্যাশা পিনাক ৬ লঞ্চ ডুবি ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করুণ। লঞ্চ ডুবির কারণগুলি জনসম্মূখে আনুন। অন্তত ভবিষ্যতে আর কোন পিনাকের ভাগ্য যাতে এমন না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। তা নাহলে আমরা, বিশ্বাস করতে শুরু করব, ঘটনা ধামা চাপা দেওয়ার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দায়ীদের শাস্তিদানের জন্য অথবা ভবিষ্যতে দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্যও নয়। তাহলে জনগনের করের টাকা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনেরও প্রয়োজন নেই। দরকার নেই, মিছেমিছি ট্যুর করার, সরকারের অর্থ ব্যয় করার, আর কর্মঘন্টা নষ্ট করার।
(মোতাহার হোসেন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ)