বেপড়োয়া বাস ড্রাইভার – এ ফ্লাইওভারের উন্নয়ন দিয়ে আমরা কি করব!

মোতাহার হোসেন
বাস ড্রাইভার হেল্পাররা আবার একজন ছাত্রকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র সাইদুর রহমান গত শনিবার রাতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ে ঢাকা ফিরছিল। সাথে তার বন্ধুরাও ছিল। রবিবার ভোর চারটায় ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়েতে বাস জ্যামে পড়লে, সাইদুর প্রকৃতির ডাকে নেমে পড়ে। পরে জ্যাম কেটে গেলে বাস ছেড়ে দেয়। এ সময়ে দৌঁড়ে এসে সাইদুর বাসে উঠার চেষ্টা করলে আহত হয়। আহত সাইদুরকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না নিয়ে, বাস কর্মীরা তাকে নদীতে ফেলে দেয়। এতে তার মৃত্যু ঘটে।সাথে তার বন্ধুরা ছিল বলে, অপরাধীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। বন্ধুরা না থাকলে হয়তো জানাই যেত না, অপরাধী কে। এভাবে বাস কর্মীরা আরো কত লাশ যে গুম করে ফেলে নাই, তার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে?
এই বছরই এপ্রিল মাসে, দুই বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের আরেক ছাত্র রাজীবের হাত ছিঁড়ে ফেলে। এতিম রাজীব পরে মারা যায়। সেই এপ্রিল মে মাসেই উদ্ধত্য বাস কর্মীরা খুন করে আরো কয়েকজন ছাত্র জনতা। একাধিক রমণীর ইজ্জত লুণ্ঠণ করে। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে; সংবাদ পত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচুর লেখা লেখি হয়। কিন্তু প্রতিকার কিছুই হয় নি, হবেও না।
গত কয়েকবছর ধরেই সড়ক পথে নৈরাজ্য বেড়েই চলেছে। আগে যে ছিল না, তা নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমাগত এর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। এর নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ভাবলে গা শিউরে উঠে। একটু পিছনে ফিরে তাকালেই দেখা যায়, গত ২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সৈয়দ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর ঢাকা পাটুরিয়া মহাসড়কে মানিকগঞ্জের গিউরের কাছে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়। প্রবল প্রতিবাদ হয়, বেপড়োয়া ড্রাইভারদের শাস্তির দাবীতে।
তাদের মানবিক ও কারিগরী শিক্ষাদানের বিষয়ে সুধীজনরা জোড়ালো বক্তব্য দেয়। এ বিষয়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্ট হয়। সরকার বিব্রত অবস্থায় পড়ে। এর প্রেক্ষিতে ড্রাইভারদের নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টাও হয়। কিন্তু সরকারেরই একটি মহলের উস্কানিতে অবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যায়। এর ফলশ্রুতিতে, এখন আর মানুষ, রাস্তা ঘাটে নিরাপদ বোধ করছে না। বাস দেখলেই মানুষ মনে করে, মৃত্যুদূত আসছে। বাস, কারো হাত ছিঁড়ে নিচ্ছে, কারো বা পা। কাউকে অবলীলায় পাঠিয়ে দিচ্ছে একেবারে ওপারে। এই ঔদ্ধত্য থামছেই না, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে একদিনও এমন যাবে না যে, বাস ড্রাইভাররা কারো না কারো হাত পা ভেঙে দিয়েছে অথবা একেবারেই মেরে ফেলেছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর সারা দেশের সড়ক দূর্ঘটনায়, নিহত হচ্ছে দশ হাজার মানুষ। আহত হয়ে সাময়িক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এর দিগুণ। সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে তিন হাজার। এই হিসাব কয়েক বৎসর আগের। এখন আরো বাড়বে।
ঢাকা শহরের মাত্র একটি রুটে, জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে সংসদ ভবন এলাকার উড়োজাহাজ মোড় পর্যন্ত, এ সামান্য কয়েক কিলোমিটার রাস্তায়, ২০১৫ সালের ৩৯ মাসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হাড়িয়েছেন ১১৭ জন। মারাত্বক আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন ৩২ জন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এসব পঙ্গুরা বেশীরভাগই ভিক্ষাবৃত্তির পেশা গ্রহণ করে। এছাড়া আজ রাজীবের প্রাণ, কাল ফারুকের হাত অথবা পা, পরশু আরেকজনের মাথা, তার পরদিন দেবজানির ইজ্জত, এসবতো লেগেই আছে!
বছর কয়েক আগে, সাংবাদিক বন্ধু জগলুল হায়দার চৌধুরীকে রাজধানীর সোনারগাঁ ক্রসিংয়ে একটি বাস মেরে ফেলে, এ নিয়েও লেখা লেখি কম হয় নি। কিন্তু ড্রাইভারদের থামানো যায় নি, ঔদ্ধত্য একটুও কমে নি। কলম যোদ্ধাদের লেখনি শক্তি বরং কমেছে। গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সংবাদ আগের মত গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথবা লিখলেও তা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে না।
বাস কর্মীদের সীমাহীন বেয়াদপির কারণে মা বোনেরা দূরুদূরু বক্ষে প্রাণ এবং ইজ্জত দুটোই হাতে নিয়ে বাসে উঠে। সুযোগ পেলে ড্রাইভার হেল্পাররা ৭ থেকে ৭০ বছরের কাউকে ছাড়ছে না। অকারণে যার তার গায়ে হাত দেওয়া তো আছেই। না, শান্তি নেই, স্বস্তিও নেই। শুধু সাধারণ যাত্রী মা বোনদের কথাই বলছি কেন, স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালেয়র ছাত্রীরাও এদের হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
যদি যাত্রী সাধারণ কিংবা স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীর সড়কপথে সামান্য নিরাপত্তা দিতে আমরা না পারি, শান্তি দিতে না পারি, অন্তত স্বস্তি দিতেও না পারি, তবে এ ফ্লাইওভারের উন্নয়ন দিয়ে আমরা কি করব!