লেজে-গোবরে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা

মোতাহার হোসেন
মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলা, পঙ্গু করে দেয়া, সাত থেকে সত্তর বছর বয়সী নারীদের সুযোগ পেলে ধর্ষণ করা এবং অসহনীয় যানজটে লেজে-গোবরে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা। সড়ক পথে প্রতিবছর দশ হাজার লোক মারা যাচ্ছেন। এর বেশী সংখ্যক পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন, অকালে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েকবছর পূর্বের সমীক্ষা। বর্তমানে এর সংখ্যা যে অনেক বেশী তা অনুমেয়। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের একটি মাত্র রুটে, প্রেসক্লাব থেকে উড়োজাহাজ মোড় পর্যন্ত, সড়ক পথে মাত্র ৩৯ মাসে মারা গেছেন ১১৭ জন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ৩২ জন। এছাড়া সাম্প্রতিক কালে কাটা হাত রাজীবের হত্যাকাণ্ড, পা হারানো রোজিনার মৃত্যু, রাসেলের মৃত্যুর সাথে লড়াই, এসব তো লেগেই আছে।
ড্রাইভারের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে, গত ২০১১ সালে চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও মুনীর চৌধুরীর ছেলে মাশুক মুনীরের মৃত্যু, সোনারগাঁও ফোয়ারার কাছে সাংবাদিক জগলুল হায়দারের মৃত্যু, সড়ক পরিবহণে নৈরাজ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলছে।
এর উপর মরার পর খাড়ার ঘা’র মত যুক্ত হচ্ছে ধর্ষণ, সাত থেকে সত্তর বছর বয়সী কোন নারীকে বাদ দেয়া হচ্ছে না। সুযোগ পেলেই সুযোগ নিচ্ছে মাদকাসক্ত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ড্রাইভার-হেল্পার। ধর্ষণ করছে, ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ফেলে দিচ্ছে কোন নির্জন স্থানে; এতটাই বেসামাল ড্রাইভার-হেল্পার। দুরুদুরু বক্ষে মা বোনেরা বাসে উঠছেন, প্রাণ ও মান দুটোই হাতে নিয়ে। বাসে উঠা এবং বাস থেকে নামার সময় অকারণে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া হচ্ছে, নেক্কারজনক ভাবে প্রকাশ্যে।
কয়দিন আগেও এসব খবর গুরুত্বের সাথে ছাপানো হত। ইদানিং এজাতীয় খবর তেমন একটা গুরুত্বই পাচ্ছে না। এইতো সেইদিন, গত ১৫ই মে মাত্র একদিনে সড়ক দূর্ঘটনায় সাড়া দেশে প্রাণ হারান ১৮জন। হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার ও ময়মনসিংহে একইদিনে, একই তারিখে।আর ৪৫০ দিনে মারা গেছেন ৪১০৮ জন [ সূত্র: দৈনিক প্রথমআলো]। অথছ এই ভয়াবহ প্রাণহানির খবর সব কয়টি জাতীয় পত্রিকায় প্রথম পাতায় আসে নি। গা-সওয়া হয়ে গেছে। খবরের গুরত্ব কমে যাচ্ছে। যারা ড্রাইভার হেল্পারদের ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা এটাই চেয়েছিলেন। তারা যা চেয়েছিলেন, তাই হতে যাচ্ছে। দূর্ভাগ্য আমাদের।
আর যানজটের কথা কি বলব! সীমাহীন যানজটে সারাদেশ নাকাল। দুই চার ঘন্টা নয়। কত হাজার ঘন্টা যে যানজটে নষ্ট হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব নাই। একদিন দুইদিন নয়, বৎসরের পর বৎসর, মাসের পর মাস। এতে যাত্রীদের অবর্ণনীয় কষ্ট। মুমূর্ষ রুগীর করুণ আর্তনাদ সবই বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখাচ্ছে আমাদের ফ্লাইওভারের উন্নয়নকে, এই ফ্লাইওভারের উন্নয়ন দিয়ে আমরা কি করব?
আগে আইনের কড়াকড়ি ছিল। আইন প্রয়োগে কঠোরতা ছিল, এখন এসব কিছুই নাই। সব জামিনযোগ্য মামলা হচ্ছে। মার্ডার কেস হচ্ছে না একটিও। জামিন নিয়ে সহজেই বেড়িয়ে, আবার স্টেয়ারিং হাতে নিয়ে আরেকজনকে মারার অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। অন্যদিকে কবরে অথবা হাসপাতালে আছেন ভিকটিম। অবশ্য একটি মাত্র মামলা হয়েছে এটেম্পট টু মার্ডারের। যা জামিন অযোগ্য। মে মাসে, সড়ক পথে এতগুলো হত্যার মধ্যে একটি মাত্র এটেম্পট টু মার্ডার মামলা তাও ভিকটিম পুলিশ ইন্সপেক্টর বলে, বাকী সবকয়টি জামিন যোগ্য মামলা। অপরাধ প্রমাণ হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র তিনবছর জেল। প্রাক্টিক্যালি কিছুই হবে না। ড্রাইভারদের ঔদ্ধত্তের কারণ এটিই। আর খুঁটির জোর হচ্ছে, ওদের নেতা একজন মন্ত্রী। শ্রমিক ফেডারেশানের অন্যান্য নেতারারুলিং পার্টির প্রভাবশালী নেতা। তাই বলছিলাম, এখন দরকার আইনের সংস্কার, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতা এবং দ্বায়িত্বশীলতা।
একবার কাগজে দেখলাম। গ্রামে ময়মনসিংহ এর দিকে মুলা বিক্রি হচ্ছে এক টাকায় চার হালি, ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে এক হালি চার টাকা। জানতে চাইলে দোকানী বলল, কৃষকরা যদি বিনাপয়সায়ও দেয়, তবুও আমাদের বিক্রি করতে হবে, হালি চার-পাঁচ টাকায়। কারণ পরিবহণের চাঁদাবাজি, জ্বালানী ব্যয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অবাক হইনি, জানতাম এই কথাই বলবে। এতে একদিকে যেমন কৃষক পাচ্ছে না তার ন্যায্য পাওনা, অন্যদিকে ক্রেতারা কিনছেন চড়া দামে। শোষিত হচ্ছে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ই। মাঝখানে ফুলে ফেঁপে উঠছেন চাঁদাবাজ। চাঁদা আর চাঁদা। মালিকের চাঁদা, শ্রমিকের চাঁদা, পুলিশের চাঁদা আর ক্ষমতাসীনদের চাঁদা। এযেন এক চাঁদার হাঁট-বাজার। তার উপর, পরিবহন ব্যবসায় মালিকদের মুনাফাপ্রেম, বেপরোয়া মারমুখি। এটা কি কোন সভ্য দেশের চিত্র হতে পারে! সুশীল সমাজের তো অবশ্যই নয়। কি বলবেন আমাদের স্বঘোষিত সুশীল সমাজ?
(মোতাহার হোসেন‌, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ)