সীমান্তে পানি বন্টন আর নয়ঃ চাই নদীর অববাহিকা ব্যবস্থাপনা

মোস্তফা কামাল মজুমদার
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন গতকাল ভারত সফরের সফলতা নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতার আশ্বাসের কথা জানিয়েছেন। উক্ত সফরের সময় উভয় দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশের একটা প্রধান নদী তিস্তা। ব্রহ্মপূত্র নদের অন্যতম প্রধান এই উপনদীর উৎপত্তি ভারত-চীন সিমান্তে হিমালয় পর্বতের সাত হাজার একশত আটাশ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পাহাংগিরি থেকে। সুষম পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে ২০১১ সালে এ নদীর যৌথ ব্যবস্থাপনার জন্য ভারতের তখনকার প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় একটা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। তার উত্তরসূরী বর্তমান প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম মেয়াদ পূর্ণ হতে চলেছে। এখনো বলা হচ্ছে তিস্তা চুক্তি চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশ থেকে একই রকম কথা শোনা যাচ্ছে। কোন লক্ষ্যে এবং কিসের ভিত্তিতে এই চুক্তি হবে তার কোন বিস্তারিত তথ্য তারা দিচ্ছেন না। কিন্তু এখনকার বিশ্বে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উল্লেখিত চুক্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এমন সংশ্লিষ্ট এই দুই দেশের জনগোষ্টির মতামত নেয়া উচিত।
কারন কোন নদীর উৎপত্তি থেকে সাগরে পতনের পূর্ব পর্যন্ত পুরো বিষয় চুক্তির আওতা না আসলে, শুধু সীমান্তে পানি বন্টনের ফর্মূলা দিয়ে টেকসই বা দীর্ঘ-মেয়াদী সমাদান হবেনা। দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তির যে দুর্বলতাগুলো এখন পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে, তার পুনারাবৃত্তি যেন তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে না হয় তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলে আসছেন তিস্তার পানিটুকু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তা ঠেকানোর জন্য দরকার। কিন্তু স্বাক্ষরের পূর্বে চুক্তির শর্ত ও উদ্দেশ্য সঠিক এবং পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ না করলে গংগা পানি বন্টন চুক্তির মত মারাত্মক দূর্বলতা থেকে যেতে পারে। উক্ত চুক্তির দূর্বলতার বিষয়ে তখনকার পানি মন্ত্রী মরহুম আব্দুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, চুক্তির বিস্তারিত শর্ততো আপনাদের মত বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করেন। তারা এধরনের দূর্বলতার কথা আমাদের জানাননি। আইএফসির পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনিতিকরা যেন এখনকার এবং ভবিষ্যতের যে কোন চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নদীকে প্রবাহমান রেখে তার পানি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের চিন্তা করেন। কারন চুক্তির পর যদি নদী মরে যায়, তাহলে নদীর এমন মৃত্য পরওয়ানা আমরা কেন স্বাক্ষর করব?
তিস্তা এক সময় বাংলাদেশের প্রবাহমান একটা বেশ খরস্রোতা নদী ছিল। এ নদী পুরো সিকিম রাজ্য এবং পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং ও জনপাইগুড়ি জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নীলফামারিস্থ ডিমলা থানার খরিবাড়ী সীমান্ত দিয়ে এসে বেশ কিছুদূর প্রবাহিত হবার পর কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপূত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপূত্রের সাথে তিস্তার মিলনের পর সম্মিলিত স্রোত যমুনা নদী হিসেবে পরিচিত হয়েছে। তিস্তা প্রায় ৪৪০ কিলমিটার দীর্ঘ এবং তার অববাহিকার পরিমান প্রায় সাড়ে বারো হাজার বর্গকিলোমিটার, যার অর্ধেক বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের উজানে গজলডোবায় ১৯৮৭ সালে ভারতের ব্যারেজ নির্মান সমাপ্ত করার পর থেকে, তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুকনো মওসূমে তিস্তার সর্বনিম্ন প্রবাহ সেকেন্ডে ৭,০০০ (সাত হাজার) কিউবিক ফুট (কিউসেক) থাকার কথা। কিন্তু বিগত তিন দশকে তার সর্বনিম্ন প্রবাহ ৩০০ কিউসেকের নীচে নেমেছে। গজলডোবায় ব্যারাজ তৈরীর উদ্যোগ ১৯৭০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হলেও নির্মান কাজ আরম্ভ হয় বাংলাদেশে তিস্তা ব্যারেজের নির্মান শুরুর দু’বছর পর এবং তা সমাপ্ত হয় বাংলাদেশের ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজের প্রথম প্রকল্প সমাপ্ত হবার পর। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনিটরিং অনুসারে বর্তমানে গজলডোবা ব্যারাজের স্লুইস গেট দিয়ে চুইয়ে যে পরিমান পানি আসে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ তাই পাচ্ছে। গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পুরো প্রবাহ আটকে রাখা সম্ভব। শুষ্ক মওসুমে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ প্রায়শঃ ৩০০ কিউসেকে নেমে আসে।
২০১৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ভারতীয় লেখক গৌরি নোলকারের বর্ননা থেকে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের চিত্র ফুটে উঠে। সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স আন্ড পিপল (সানডারপ) প্রকাশিত গৌরি নোলকারের তিস্তার, বাংলাদেশ পশ্চিম বংগ ও সিকিমের অংশ নিয়ে তিন কিস্তির লেখা বাংলাদেশের জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা গ্রীনওয়াচ ঢাকা পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। গৌরি নোলকারের গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল থেকে পশ্চিম বংগ হয়ে সিকিমে এ নদীর উৎসস্থল পর্যন্ত ভ্রমন করে তার বর্ণ্না লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর লেখা বাংলাদেশ অংশের বর্ণনা –
“…At the Teesta Bridge, any confusion about the deteriorating conditions of the river vanished. The river was clearly dry, dying. The wide riverbed was a testimony to her once-abundant, fierce waters, which rolled down furiously from the Himalayas. Now, all I saw was a mild remnant of the past, a soft lapping of the modest bundles of water as they hurtled in to where I was coming from.” – – সূত্র সানডারপ।
গৌরি নোলকারের দেয়া তিস্তার পশ্চিম বংগ অংশের বর্ণনার খানিকটা নিম্নে দেয়া হল –
“Nowhere was the condition of the river more apparent than at Gajaldoba barrage. Upstream, there was water as far as you could see. Downstream, the river bed was exposed like an uncomfortable wound. On the banks of the river, a small bazaar had bloomed, and the government had put up a board depicting an ambitious plan to develop the area around the barrage into a sophisticated tourist spot. And yet, the bustling market and the plans gave me little respite in comparison to the sorry state of the river. I was expecting to see this and yet, I was aghast; the reality was too evident and in your face.
The twisted image of Teesta, wrung out at some places, drenched at other, lingered on in my mind. It was only at Sevoke where the river hits the plains that she bloomed in all her beauty and took my breath away. The historical Coronation Bridge and the Teesta Railway Bridge, which connect the North East to the rest of India, are just a few kilometres from each other. On my way to Kalimpong from Siliguri, I couldn’t help but stop and spend a few moments admiring the meeting of the hills and the plains and, in their lap, a youthful river.” – সূত্র সানডারপ।
তিস্তার সিকিম অংশের বর্ণ্নায় গৌরি নোলকারের লিখেছেন –
“From Singtam, I travelled further north to Mangan, headquarters of the district of North Sikkim. This second leg of the journey was even more beautiful, though I saw less of the river now, except near Dikchu, where it came back in sight, swelling and brown from the Himalayan silt. I could see more and more sign boards of the NHPC (and other companies’) hydropower projects, the bone of contention between state (and central) authorities and the Sikkimese people, most notably, the Lepchas.”

  • সূত্র সানডারপ।
    তার লেখায় পশ্চিম বঙ্গে তিস্তার পানির প্রাচুর্যের এবং বাংলাদেশে নদীটা শুকিয়ে যাবার বিবরণ খুবই স্পষ্ট।
    বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল বর্তমান পর্যায়েও যৌথ নদীর বিস্তারিত তথ্য উপাত্য বিনিময় হয়না। কিন্তু নদী ব্যবস্থাপনার হালের চিন্তা ভাবনা হচ্ছে সার্বিক। পুরো অববাহিকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। নদীর প্রবাহ সাগর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে হবে। তা নাহলে ঘটবে নদীর অপমৃত্যু। কারণ একটা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অন্যত্র সরিয়ে নিলে নদীর অপমৃত্য অবধারিত। তিস্তার বাংলাদেশ অংশে তা পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে নদী ভাটিতে মরে গেলে উজানেও তার মৃত্যু হবে। আবার টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত আমু দরিয়া বা নদীতে কয়েক দশক পর আবার পানির প্রবাহ ফিরে আসায় তা প্রমানিত হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় শতশত ড্যাম ভেংগে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার নজির রয়েছে।
    পশ্চিম বংগ সরকার বিভিন্ন সময়ে বলেছেন তিস্তা নদীর প্রবাহ গজলডোবাতে কমে গেছে। কাজেই বাংলাদেশকে পানি দেবে কিভাবে? ভারতের কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতার আসার পর থেকে পশ্চিম বংগ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিঞ্চিত পরিবর্তন দেখা যায়। ভারতের বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর জুন ২০১৫ বাংলাদেশ সফরের সময় পশ্চিম বঙ্গের মূখ্য মন্ত্রী মমতা বানার্জী বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু তিস্তা চুক্তির কথাবার্তা খুব একটা এগোয়নি। বাংলাদেশের অবস্থান আগের মতই আছে। কিন্তু পুরো তিস্তা নদীর অবস্থা সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সার্বিক প্রস্তুতি না নিলে কুটনৈতিক মারপ্যাঁচে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। পুরো তিস্তা বেসিন নিয়ে চুক্তি করতে না পারলে, গজল ডোবার কি পরিমান পানি পাওয়া যাবে তার হিসেব নিকেশ করে কোন লাভ হবেনা। কারণ নদীর উৎসমুখ থেকে শুরু করে সাগর পর্যন্ত বা নিদেনপক্ষে বাংলাদেশে ব্হ্মপূত্র পর্যন্ত উক্ত নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার কথা চুক্তিতে না থাকলে তা নিরর্থক হবে।
    প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তিস্তার সিকিম অংশে ৬টা জলবিদ্যুত প্রকল্পের ড্যাম রয়েছে। তার মধ্যে খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থাসহ রাঙ্গিত ৩ ড্যাম, জলবিদ্যুতের রংপো ড্যাম, রংলি ড্যাম এবং তিস্তা ৫ ড্যাম চালু আছে, তিস্তা ৩ ড্যামের নির্মান কাজ এগিয়ে চলছে এবং তিস্তা ৪ ড্যাম নির্মানের অপেক্ষায় আছে। আরো প্রায় ১৫টা ড্যাম নির্মানের চিন্তা ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। সিকিমের লেপচা গোত্র তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কারন রান অব দ্যা রিভার বলে পরিচিত প্রযুক্তিতে তৈরী ড্যামগুলো ব্যবহার করে নদী থেকে পানি জলবিদ্যুত তৈরীর টারবাইনে নিয়ে গিয়ে ভাটিতে আবার নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও পরিকল্পনাকারিদের বক্তব্য – পানির অপচয় তারা করেন না, স্থানীয় জনগোষ্টি মনে করে নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়ায় তাদের পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেখানে নদীর কিছু অংশে প্রবাহ থাকেনা বললেই চলে। তাছাড়া নদীর মূল প্রবাহ টারবাইনে নিয়ে গিয়ে আবার নদীতে ফেরত পাঠানোর পর্যায়ে কমপক্ষে শতকরা দশ ভাগ পানির অপচয় হয়।
    সিকিমের সুউচ্চ পর্বতের উপর থেকে শুরু করে গজলডোবার সমতল ভূমি পর্যন্ত নির্মিত ড্যাম-কাঠামো সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের খুব কমই ধারণা আছে। কিন্তু এই পানি-কাঠামোগুলো নদীর সার্বিক প্রবাহ শুধু নয়, তার জীব বৈচিত্র তথা ইকোসিসটেমের অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। আন্তসীমান্ত বড়সড় সার্ভে বা গবেষনার মাধ্যমেই শুধু এ ক্ষতির পরিমাপ করা সম্ভব। কাজেই তিস্তা নিয়ে দরকার সার্বিক নদী ব্যবস্থাপনার চুক্তি। তা উপেক্ষা করে গজলডোবা প্রাপ্ত পানির বন্টন চুক্তি করলে তা অর্থবহ কিছু হবেনা। প্রবাহ কমে গেলে গঙ্গার মতই বলা হবে হিমালয়ে বরফ গলেনি, উপর থেকে পানি না আসলে কোথা থেকে দেব।
    একটু খোঁজ করলেই জানা যায়, তিস্তা নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করে ভারতের আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের ১ নং সংযোগটা সম্পন্ন করা হচ্ছে। তিস্তার পানি মহানন্দি হয়ে গঙ্গায় পড়ছে। সেখান থেকে পশ্চিম বঙ্গের অন্যত্র এবং আরো দক্ষিনে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ তিস্তার বাংলাদেশ অংশ মরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপূত্রের তিন উপনুদী মানস, সঙ্কোস ও তিস্তার মধ্যে তিস্তা সবচেয়ে বড়। তিস্তা নদীর প্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ার শুকনো মওসূমে ব্রহ্মপূত্রের প্রবাহ কমে গিয়ে বড় বড় চর জেগেছে। অন্যদিকে গঙ্গার মৃতপ্রায় স্রোত তার সাথে মিলিত হবার পর সৃষ্ট পদ্মা নদীরও একই অবস্থা। সংকুচিত পদ্মার স্রোত মেঘনার সাথে মিলিত হবার পর শুকনো মওসূমে মেঘনার প্রবাহও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কমে যায়। শুকনো মওসূমে মেঘনা এবং গংগার শাখা নদী গোরাই –এর প্রবাহ সমূদ্রের পানির লবনাক্তাতা ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট থাকেনা। এখন নদীর পানিতে লবনাক্ততা ফরিদপূরের রাজবাড়ী পর্যন্ত উঠে এসেছে। নিয়ে এসেছে জীবজগতের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
    বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, যে দেশের সৃষ্টি নদী থেকে, সেদেশে নদীর মৃত্য একটা বড় অশণি সংকেত। প্রকারান্তরে বাংলাদেশের ভৌগলিক অস্তিত্বের সংকটের পূর্বাভাস স্বাভাবিক নদী প্রবাহ না থাকলে পৃথিবীর এই বৃহত্তম বদ্বীপটির গঠন প্রক্রিয়া পালটে গিয়ে উলটো সমূদ্র ভাংগনের বিপদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৬ কোটি মানুষের আবাসভূমি এ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের ভীতিকর লক্ষন সম্পর্কেও তারা হুসিয়ারি উচ্চারণ করছেন। গঙ্গা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের মত অন্যত্রও কৃষি, মৎস ও শিল্প উৎপাদন শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা, নৌ চলাচল আরো সীমিত হয়ে যাবে। অপরিনামদর্শি নদী ব্যবস্থাপনার জন্যে, জীবচক্র, জীবৈচিত্র এবং জীবজগত ক্ষতিগ্রস্ত হলে নেমে আসবে সার্বিক বিপর্যয়।
    তাই যৌথ নদী ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশের ভৌগলিক অস্তিত্বের প্রশ্নে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। নিজের অস্তিত্বের সংকটের কথা জানানো বন্ধুত্বের কাজ। তাকে কোন বিচারেই শত্রুতা বা বন্ধুত্ব বিনষ্টকারি কর্মকান্ড হিসেবে দেখা যায় না। পানি বঞ্চিত গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকায় মরুময়তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। তাকে বাংলাদেশের মানুষ মরণ ফাঁদ মনে করে। নদীর পানি সঙ্কটের কারণে গঙ্গা-কপোথাক্ষ এবং অন্যান্য বড় সেচ প্রকল্পে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে খাবার পানিতে আর্সেনিক দুষণ, যা আগে কখনো কল্পনাও করা যায়নি। বিষেষজ্ঞরা বলছেন আর্সেনিক সমস্যার সমাধান ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারের মধ্যে নিহত। কিন্তু পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা যায়, তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানির চাহিদা মেটাতে ডিপ-টিউব ওয়েল বসানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তাতে আর্সেনিক সমস্যা ভয়াবহতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলাদেশের খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় বলা হয়। এখানে উল্লেখ রাখা দরকার, নদী প্রবাহমান না থাকলে বর্ষায় বন্যার প্রকোপ ও ক্ষয়ক্ষতি অনেকগুন বাড়বে। শুকনো মওসূমে সর্বনিম্ন প্রবাহ এখন ৩০০ কিউসেক। কিন্তু বর্ষায় এ নদীর সর্বোচ্চ প্রবাহ ৩০০,০০০ (তিন লাখ) কিউসেক।
    ভারতের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পানি নিয়ে বিরোধ আছে। এবং তা নিয়ে হাই কোর্ট, সূপ্রিম কোর্টে বিচার হচ্ছে। মাস খানেক আগে ভারতের সূপ্রিম কোর্ট কাবেরী নদী বিরোধ নিষ্পত্তির রায় দিয়েছেন। আমাদের কথা আমাদের নিজেদেরই বলতে হবে। ইতোপূর্বে একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে বিশিষ্ট নাগরিকরা ভারতীয় সূপ্রিম কোর্টের কাছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য দরখাস্ত করেছেন। সেগুলো আমলে নেয়া হয়নি কারণ, বাংলাদেশের নাগরিকরা সে কোর্টের আওতায় পড়েন না।
    এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি (আইএফসি) গোড়া থেকেই যৌথ নদীগুলোর সুষম ব্যবস্থাপনার পক্ষে বক্তব্য রেখেছে। ২০১১ সালে মনমোহন সিং-এর এবং ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় এবং বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৭ সালে ভারত সফরের সময় এব্যপারে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রেখেছে, দুই বন্ধু দেশের মধ্য সুসম্পর্কের আরো উন্নয়নের লক্ষ্যে।
    আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে যৌথ নদীর পানি ব্যবস্থাপনার সংকটের ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাপক গনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন বিএনপি, বাসদ, সিপিবি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বিভিন্ন রজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন পানির দাবিতে লংমার্চ, সেমিনারসহ অনেক কর্মসূচিতে সোচ্চার হয়েছে।
    মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ফারাক্কা লং মার্চের মাধ্যমে যে জাতীয় সংহতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন সে চেতনা বুকে ধারণ করে পানি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশে ইতোমধ্যে একটা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জনগনকে সকল রাজনৈতিক বিভাজনের উর্ধে উঠে পানির ন্যায্য অববাহিকা ভিত্তিক সমন্বিত ব্যবস্থাপনা আদায়ের জন্য দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।