Justice done

১৩ বছর হাওয়ার সাথে যুদ্ধ – ইতিহাসের পাতা থেকে।

মোতাহার হোসেন।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দাদা, জহর লাল নেহেরুর পিতা মতিলাল নেহেরু যখন এলাহাবাদ হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি করতেন সেসময়ের কথা। ভারতের উত্তর প্রদেশে জশোবন্ত সিং নামে একজন সম্ভান্ত কৃষক ছিলেন। চাষাবাদের জন্য তার ছিল জমিজমা, মৎস্য চাষ ও পশু পালনের জন্য কিছু হাওর বিল। চাষাবাদের জন্য কিছু মজুর এবং নিরাপত্তার জন্য ছিল জনাকয়েক লাঠিয়াল পালোয়ান। তাই দিয়ে ইংরেজদের সাহায্য করেন আঠারশ সাতান্ন সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়। পুরষ্কার হিসেবে পান সুবিশাল জমিদারী এবং রাজা উপাধি। কৃষক জশোবন্ত এখন রাজা জশোবন্ত সিং। রাজার ছিল এক্টিমাত্র পুত্র সন্তান, নাম বলবন্ত সিং। পিতার অবাধ্য সন্তান। জশোবন্ত অনেক চেষ্টা করেও বলবন্তকে পথে আনতে পারেনি। অবাধ্যতার চরমে বলবন্ত। এমনি সময় একদিন খবর এলো বলবন্ত গ্রেফতার হয়েছে, খুনের অপরাধে। কোমরে দড়ি বেধে পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে। রাজা জশোবন্তের ছেলে খুনের দায়ে অভিযুক্ত।
পুত্রকে বাঁচাতে বড় বড় উকিল ব্যারিস্টার লাগালেন জশোবন্ত । এতো কিছুর পরেও শেষ রক্ষা হলোনা। ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচানো সম্ভব হলেও যাবজ্জীবন থেকে বাঁচানো যায়নি। ব্রিটিশ আমল, শাসন ছিল।
কেটে যায় কয়েক বছর। একসময় রাজা ভাবতে থাকে, বয়স হয়ে যাচ্ছে, এ রাজত্বের উত্তরাধিকার কাকে দিয়ে যাব। পুত্র সন্তানের আশায় দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। জেল খাটা দাগি অপরাধীটাকে তো আর রাজ্যের দায়িত্ব দেয়া যায়না। অতএব ছোট রানী আসল। সুন্দরী স্বল্প শিক্ষিতা কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। বয়সে কিশোরী। নামও কিশোর। কিশোর ছোট রানীর মর্যাদা পেয়ে অন্দরমহলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল সহজেই। কিন্তু যে কাজটি সবচেয়ে জরুরী ছিল, রাজাকে পুত্র সন্তান দেয়া তা তিনি পারেননি।
কেটে গেল আরও কয়েক বছর। রাজা জশোবন্তের বৃদ্ধাবস্তা। যেকোন সময় পরপারের ডাক এসে যেতে পারে। তাই ডাক পড়লো রাজার ব্যক্তিগত উকিলের। সময়ক্ষেপণ না করে উইল করা হলো, দলিল রেজিস্ট্রি করা হলো। উইলের শর্ত হচ্ছে; ” আমার মৃত্যুর পর এ জমিদারির (রাজত্ব) দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ছোট রানী কিশোর। তবে ১৬ বছরের মধ্যে আমার একমাত্র পুত্র বলবন্ত সিং এর যদি পুত্র সন্তান হয় তাহলে, আমার নাতীর বয়স আঠার বছর হলে অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক হলে ছোট রানী কিশোর তাকে (নাতীকে) জমিদারি বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে।”
এরপর একসময় রাজা মারা গেলেন। রানী তখন জমিদারি চালাচ্ছেন। এক সময় বলবন্তের জেল খাটার দিন শেষ হয়। এলেন রাজবাড়িতে । কিছুদিন থাকলেনও। কিন্তু রানির আশ্রিত হয়ে বলবন্ত রাজবাড়িতে থাকবেনা। নিজের কিছু জায়গা জমিন ছিল, তা নিয়ে রাজবাড়ি ছারলেন বলবন্ত সিং। স্ত্রী নারায়ণীর সন্তান ধারনের ক্ষমতা নেই। কিন্তু পুত্র সন্তান তার চাই ই চাই। অতএব দ্বিতীয় বিয়ে। বলবন্তের স্ত্রী লাবনি যথা সময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় নাম রাখে নর সিংহ রায়। স্ত্রী লাবনি এবং পুত্র নর সিংহকে রেখে একসময় বলবন্ত শং ও মারা যায়। নর সিংহ র বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে নর সিংহ ছোট রানীকে নর সিংহের উকিল নোটিশ;- “আমি নর সিংহ রায় , প্রয়াত বলবন্ত সিং এর পুত্র, প্রয়াত রাজা জশোবন্ত সিং এর নাতী। একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকার; উইলের শর্ত মতে অবিলম্বে আমাকে জমিদারি বুঝিয়ে দেয়া হোক; নচেৎ………
মামলা শুরু হয়ে গেল। ছোট রানীর প্রতিনিধি, ছুটলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার মতিলাল নেহেরু সকাশে । একের পর এক মামলায় রানী জিতে যাচ্ছিল। কিন্তু যেদিন থেকে ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমান হলো দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী লাবনিই নর সিংহ এর মা এবং বলবন্ত সিং তার পিতা। সেদিন থেকে রানীর হেরে যাওয়া শুরু হলো। একটাতে হেরে যান তো মতিলাল নেহেরু উপরের কোর্টে আপিল করেন। এমনি করে মামলা গড়ালো প্রি ভি কাউন্সিল পর্যন্ত। সর্বচ্চ আদালত। খোদ লন্ডনে বসে বিচারপতি এবং আইনজীবী গন সবাই বৃটিশ । মহা কাণ্ড। ভারত বর্ষের এক জমিদারের উইল নিয়ে মামলা প্রি ভি কাউন্সিলে।
প্রি ভি কাউঞ্চিলে রানীর উকিল স্যার জন সাইমন বললেন, “মাই লর্ড, আমি স্বীকার করছি নর সিংহ রায় প্রয়াত বলবন্ত সিং এর পুত্র, প্রয়াত রাজা জশোবন্ত সিং এর নাতী। কিন্তু জশোবন্ত সিং নাতীকে জমিদারি দেয়ার যে ব্যাবস্থা করে গেছেন তা আইন বিরোধী। বেআইনি। আইনের চোখে এর কোন মুল্য নেই। বস্তুত যার জন্মই হয়নি তাকে উত্তারিধিকার নিয়োগের কোন বিধান নেই।”
প্রি ভি কাউন্সিল অবাক হয়ে দেখলেন, সত্যিই তো। দলিলের এ অংশটুকু ‘ব্যাড ইন ল’।
তের বছর মামলা চালিয়ে প্রমান হলো নর সিংহ জশোবন্ত সিং এর নাতী, এটা ঠিক, তবে তিনি জমিদারি পাবেন না। হাওয়ার সাথে তের বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করলো উকিল জজ ব্যারিস্টার আর বাদী বিবাদী । – (ল’ রিপোর্ট অবলম্বনে)