স্বাধীনতার পরম্পরা..!

সোহেল মাহমুদ সাগর
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-জির ঐতিহাসিক ভাষণেই প্রোথিত বাংলার স্বাধীনতা। ১৯৪৭-এ ইংরেজদের শাসন থেকে দেশ মুক্ত হলেও ফের উপদ্রব স্বরূপ প্রকট হয় পাকিস্তানি শোষক ও শাসক গোষ্ঠীর অনৈতিক ও ধনসম্পদ লুটপাটের শাসন। ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ৫৭-র স্বায়ত্তশাসন দাবি, ৬২ ও ৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে বাঙাল দামাল ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। ২৫শে মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী শুরু করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-জির মহান স্বাধীনতার ইশতাহার। অতঃপর শুরু হয় দখলদার বাহিনীকে অপসারণে অদম্য সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর কাঙ্ক্ষিত বিজয় সুনিশ্চত হয়। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা দিবসে আনন্দের পাশাপাশি বেদনার সুরও বাজবে বাঙালির হৃৎস্পন্দনে। আর তাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আসন্ন ২৬শে মার্চে জাতি স্মরণ করবে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী জানা-অজানা সব তেজস্বী শহিদদের।১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ -এই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে গোটা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করেন। জাতির জনকের সেই ৭ই মার্চের ভাষণের আংশিক অর্থাৎ পাক-হানাদার বাহিনীর কালো থাবা থেকে বাংলাদেশ নামক ভৌগলিক মানচিত্র তথা দেশমাতৃকা মুক্ত হয়। তয় মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা -এ ত্রিভূজের প্রকৃত মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি আদৌ। আরো স্পষ্ট করে বলা এই যে, দেশের জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সামাজিক মুক্তির আন্দোলন কেবলই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে দ্বন্দযুদ্ধ (duel); আর অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ পাকিস্তানি দোসরদের সম্পৃক্ত করে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দীক্ষায় বহুদলীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা ক্যাঁচরম্যাচরে বাত্যাতাড়িত আজকের বাংলাদেশ। তয় এক ভিন্ন আবহে জাতির সামনে আসন্ন এবারের স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘকালের দাবি পূরণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বহু আগেই। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাসহ আরো কয়েকজনকে ইতোমধ্যে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। চিহ্নিত বাকী যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
এরও আগের ইতিহাস মতে ব্রিটিশ শাসিত বাংলা, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তথাকথিত স্বাধীনতা লাভ করলেও বিভাজিত বাংলার দুই অংশের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান । পাকিস্তান অধিনস্ত পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) জনমানুষের উপর পাকিস্তানিদের জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা আন্দোলন শুরু করে ও যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা যিনি দিয়েছিলেন তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে এই নিয়ে বিস্তর রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও কিছুদিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অ্যামেরিকা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন রিচার্ড নিক্সনের শাসনামলের সকল কূটনৈতিক গোপন নথি প্রকাশ করলে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর এতে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অগ্রপশ্চাৎ’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যশস্বী এক ইমেরিটাস অধ্যাপক লিখেন, ‘চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে এরা হলো রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভ এবং সেই সঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মারক। আশা করা গিয়েছিল যে তারা কখনোই পরিত্যক্ত হবে না। তাদের নির্দেশনাতেই আমরা সামনে এগোব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে মূলনীতিগুলো আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে। আর বদলে যে গেছে সেটা বোঝার জন্য সংবিধানের সংশোধনীগুলোর অবস্থার খোঁজ করার দরকার হয় না, সর্বত্রই তাদের মলিনতা টের পাওয়া যায়। পরিবর্তন গোটা আর্থসামাজিক আবহাওয়া জুড়েই ঘটেছে। আবহাওয়াটা ভালো নয়। মূলনীতি চারটি কেন এসেছিল? এসেছিল আমাদের সমষ্টিগত সংগ্রামের ফলে ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি হিসেবে। না এসে উপায় ছিল না। শুরুতে, যুদ্ধকালে, মূলনীতি ছিল তিনটি: ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। এদের কেউই ভুঁইফোড় নয়। আকাশ থেকেও পড়েনি। কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে কিংবা করুণার পথ ধরে আবির্ভূত হয়নি। তাদের আসাটা ছিল যেমন অনিবার্য, তেমনি স্বাভাবিক। একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল। বাঙালিরা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেখে পাকিস্তানি হানাদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘা লেগেছিল তাদের স্বার্থে। তারস্বরে তারা ঘোষণা করেছিল, ইসলামকে রক্ষা করবে; ইসলাম রক্ষা আর পাকিস্তান রক্ষা তাদের কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। হানাদারদের যারা পালের গোদা, সামরিক বাহিনীর মস্ত মস্ত বীরপুরুষ, তারা ধর্মকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিল না। নিজেদের শৌর্যবীর্য তারা ধর্মাচরণের ভেতর দিয়ে প্রদর্শিত করেনি। পাকিস্তানি জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তেন বলে জানা যায় না; রোজার মাস কখন আসে কখনই বা বিদায় নেয়, তার খবর যে রাখতেন না এমন প্রমাণ আছে। অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের শেষ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ খ্যাতি জঙ্গের ময়দানে যতটা না প্রকাশ পেয়েছে, ততোধিক ধরা পড়েছে মদ্যপানের আসরে। কিন্তু ওই রাষ্ট্রনায়কেরা কেউই রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি। ধর্মকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন ধর্মের স্বার্থে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাতই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে নাকচ করে দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের চেয়ে বেশি ধার্মিক; কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্রকে তারা কখনোই একাকার করে ফেলতে চায়নি। আলাদা করে রাখতে চেয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে উৎসাহী হয়েছিল, সেটাও ধর্মের প্রয়োজনে নয়, ইহজাগতিক প্রয়োজনেই। তারা আশা করেছিল, পাকিস্তান তাদের শোষণ থেকে মুক্ত করবে। হুজুরদের স্ফীতি দেখলে এখনো তারা অস্বস্তিই বোধ করে, ভরসা পাওয়া দূরের কথা।’ যশস্বী ঐ অধ্যাপক আরো লিখেন, ‘পুঁজিবাদ দৃশ্যত বেশ ভদ্র, কিন্তু ভেতরে অতিশয় নির্মম। এই নির্মমতার চেহারাটা ভয়াবহ রকমের দানবীয়। সে ন্যায়-অন্যায় মানে না, নিজের সুখ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, সবকিছু ছারখার করে দেয়। মি. হাইডরূপী পুঁজিবাদ আজ বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালাচ্ছে, রূপ নিয়েছে সে ফ্যাসিবাদের। আমরাও তার দৌরাত্ম্যের অধীনেই আছি। মুক্তির লালিত স্বপ্ন পদদলিত হচ্ছে। চতুর্দিকে তাই আতঙ্ক এবং হতাশা। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের উপন্যাসে ড. জেকিল শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে মি. হাইডেরও মৃত্যু ঘটে। কিন্তু পুঁজিবাদ যে আত্মহত্যা করবে, এ ভরসা আজ মিছে। তাকে তাড়াতে হবে; তার জায়গায় মানবিক এক সভ্যতা এখন প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষায় আছে। সে প্রতিষ্ঠা এমনি এমনি ঘটবে না, তার জন্য সংগ্রামের প্রয়োজন হবে। বিশ্বব্যাপী সে সংগ্রাম এখন চলছে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নয়, অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজতন্ত্রীরাই সেটা করছেন এবং করবেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর দুর্দশাও সে খবরটাই দিচ্ছে। একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কয়েক লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো ওই সংগ্রামেরই অর্জন। তাদের রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আজ দেশবাসীর; নীতিগুলোর স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে; বাঁচার প্রয়োজনে। এবং ভুলবার কোনো উপায়ই নেই যে লড়াইটা পুঁজিবাদবিরোধী। রাষ্ট্রীয় চার নীতির দুর্দশা পুঁজিবাদই ঘটিয়েছে, তাকে না তাড়ালে আমাদের মুক্তি নেই। এটা একাত্তরে সত্য ছিল, আজ সেটা সত্য আরও স্পষ্টরূপে।‘
এ পর্যায়ে, লাকড়ি ফাড়া কিংবা গ্রহদোষে বিভাজিত বাংলাদেশের মানুষ সকলে মিলেমিশে এক হয়ে মানব সৃষ্ট সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ‘আমিই বড়ো’ এইরূপ দম্ভ বা আমিত্ব নামক কুলাঙ্গারকে সদা বর্জন করেই স্বাধীনতার অর্জনকে সমুন্নত রাখা। আমার ভাবনাচিন্তায় স্বাধীনতার সংজ্ঞাপ্রাপ্ত পরম্পরাকে অবিকৃত রাখতে প্রয়োজন এর অমানিশা কিংবা কালবৈশাখিকে চির নির্বাসনে পাঠানো। জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণের অভিন্ন সুপথের (সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি না মানুষের দরশন। -লালন.) ডাক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ পূর্ণমাত্রায় অনুসরণ করার শপথ গ্রহণ বীরের জাতি হিসেবে সকল বাঙালির জন্য অনস্বীকার্য। আর নিজেদের মধ্যে বড়ো রকমের একটা পারিবারিক তথা সামাজিক সংস্কার আন্দোলন চর্চায় ব্রতধারী হওয়াও অত্যন্ত জরুরী।
(সোহেল মাহমুদ সাগর, গবেষক ও লেখক – ২৭ এপ্রিল ২০১৮ খ্রি। প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজের।)