গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
আজ থেকে ঠিক একমাস আগে সাত দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ মৌল চেতনা নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একটি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে মারাত্মক সংকট তৈরি করা হয়েছে সেই পরিস্থিতি থেকে এই দেশকে উদ্ধারের আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।গণতন্ত্রের সংকট সমাধানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সব সময় আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারকে চিঠি দিয়ে সংলাপের আহ্বান জানায়। সেই আহ্বানের প্রেক্ষিতে সরকারি দলের আমন্ত্রণে ১লা নভেম্বর এবং ৭ই নভেম্বর গণভবনে সংলাপ হয়েছে। দুঃখজনকভাবে এই সংলাপে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বর্তমানের গভীর সংকট থেকে উত্তরণের পথে ন্যূনতম সমঝোতা করার মানসিকতা আমরা দেখতে পাইনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ৭ দফা দাবি আমরা সরকারের কাছে পেশ করেছিলাম, তার প্রায় সবগুলোই তারা নাকচ করেছেন। এমনকি বর্তমান সংবিধান সংশোধন না করেও যে দাবিগুলো পূরণ করা যায়, তার প্রায় সবগুলোর ব্যাপারে তারা আশ্বাসতো দেনই নি, উপরন্তু সেগুলোর কয়েকটিকে সংবিধান বহির্ভূত বলে বিভ্রান্ত ছড়িয়েছেন।
উভয়পক্ষের মধ্যকার দু’টি সংলাপে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, সভা-সমাবেশ করার উপরে কোনো রকম বিধিনিষেধ থাকবে না। এবং গায়েবি মামলাসহ নানারকম রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় যারা গ্রেফতার হায়েছেন তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে এধরনের হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আশ্বাসের অব্যবহিত পরেই আমাদের দুটি জনসভা হয়েছে। একটি ঢাকায় এবং অপরটি রাজশাহীতে। এই দুটি জনসভারই লিখিত অনুমতি দিতে দেরি করে এবং সরকারি মদদপুষ্ট পরিবহন সংকট সৃষ্টি করে মানুষের জনসভায় অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। রাজশাহীতে জনসভা হওয়ার দুদিন আগ থেকে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এমনকি রাজশাহীর সঙ্গে আশপাশের অনেক জেলার বাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল।
অপরপক্ষে এই দুদিনের জনসভাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার বন্ধ করে দেয়া হবে এ আশ্বাসের পর একদিনে ১২০০ বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে দুটি ব্যাপারে সরকারপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যখন অবিশ্বাসরকম বৈপরিত্য দেখা যায়, তখন আমাদের এটা ধরে নিতেই হবে সরকার আসলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে ন্যূনতম সমঝোতা করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল না।
আমাদের দাবিকৃত সাত দফার বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণের জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। সেই উদ্দেশ্যে আমরা দাবি করেছিলাম, উভয়পক্ষের মধ্যে আরো একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হোক। তাই আমরা যৌক্তিকভাবেই চেয়েছিলাম সংলাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করে। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের দ্বিতীয় দফা সংলাপের আগেই নির্বাচন কমিশন জানায়, প্রধান দুই অংশীজন একমত হলে তফসিল পিছিয়ে দেবেন তারা। এরপরও সরকার আমাদের নির্বাচনের তফসিল পেছানোর আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তার দায়িত্ব পালন না করে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েই থেকেছে। সেটা এই কমিশনের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো দেখলেই স্পষ্ট হয়। সেই ধারবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলো। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নির্ধারিত ৯০ দিনের ৩৫ দিন বাকি থাকতেই নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা করার পর দেশের নানা স্থানে সরকারি দলের আনন্দ মিছিল প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন আসলে সরকারের চাহিদা মতোই তফসলি ঘোষণা করেছে। অথচ ১৯৯৬ সালে নির্ধারিত ৯০দিন সময় শেষ হওয়ার ১৩দিন আগে, ২০০১ সালে ১২ দিন আগে, ২০১৪ সালে ২০ দিন আগে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল। সরকারি দলের তফসিল পেছানোর আহ্বান না জানানো এবং নির্বাচন কমিশনের অতি তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করা আবারও প্রমাণ করে সরকারি আসলে আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমঝোতা চায়নি। এটা স্পষ্টভাবেই প্রতিয়মান হয়, সরকারের যাবতীয় চেষ্টার উদ্দেশ্য হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির আদলে আরেকটি নির্বাচন করা।
একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ন্যূনতম শর্তও এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও বিটিভিসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। যা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে ড. শামসুল হুদাসহ দেশের প্রায় সকল দল ও জনগণের আপত্তি থাকা সত্বেও সরকার ও নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যাবহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করেনি। এরকম একটি পরিস্থিতিতে একটা অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া খুবই কঠিন। কিন্তু এরকম ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একটা অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ৭ দফা দাবি আমরা এর মধ্যে দিয়েছি সেই দাবি থেকে আমরা সরে আসছি না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেয়ার দাবি। আমরা নির্বাচনের বর্তমান তফসিল বাতিল করে একমাস পিছিয়ে দিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণা করা দাবি করছি। সেই ক্ষেত্রেও বর্তমান সংসদের মেয়াদকালেই নির্বাচন করার সম্ভব হবে। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন চারদলীয় জোটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার স্বার্থে নির্বাচনের তফসিল দু’দফা পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। এইসব দাবি আদায়ের সংগ্রাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অব্যাহত রাখবে। সে আন্দোলন সংগ্রামের পথে নির্বাচনে অংশগ্রহণকেও আন্দোলনের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
একটা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় দায়িত্ব সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কড়া নজর রাখবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের আচরণের প্রতি। জনগণের দাবি মানা না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়-দায়িত্ব সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচন মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতাটিও হরণ করেছে। নিশ্চিতভাবে আগামী নির্বাচনটি এই দেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের নির্বাচন হবে। সেই লক্ষ্যে তার নিজের ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করার জন্য ভোটের ময়দানে থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, দশম সংসদ নির্বাচনের পর দেশে গণতন্ত্রের যে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে সেই সংকট দূর করে আমাদের ঘোষিত ১১ দফা লক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি সুখী, সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে দেশের জনগণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাশে থাকবে। (১১ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট নেতা ডঃ কামাল হোসেনের দেয়া লিখিত বক্তব্য, পাঠ করে শোনান ফ্রন্টের সমন্বয়ক ও বিএনপি মহাসচিব ফকরূল ইসলাম আলমগীর।)